গল্প, বাংলা

আমার দুই প্রেমিকা

আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকান ক্যান? আম্মুকে বলে দেবো।
কী?! আচমকা তিয়ার কথাটা শুনে থতমত খেয়ে উঠি, একেবারে বেক্কেল হয়ে যাই। বলে কি মেয়েটা? এইটুকুন মেয়ে, মাত্র ছয় ক্লাসে পড়ে, নাক টিপলে এখনো যার দুধ বেরুনোর কথা, সে কিনা আমার চোখের চারিত্রিক দুর্বলতা নিয়ে অভিযোগ তোলে! আবার আম্মুকেও বলে দেওয়ার হুমকি!
কয়েক সেকেন্ড আমি পুরো থমকে যাই। থমকে ওর মুখের ওপর তাকিয়ে থাকা আমার অবাক স্থির চোখদুটোকে একটু বাদে সরাতে বাধ্য হই। চোখ রাখি খোলা অংক বইটার ওপর। শতকরা অনুশীলনী থেকে দশটা অংক তিয়াকে হোমওয়ার্ক দিয়েছিলাম। একটাও করেনি শুনে বিরক্ত-চোখে খানিক ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, শেষটায় অবশ্য সে দৃষ্টির একটু রকমফের হতে পারে কিন্তু তাই বলে এমন সাংঘাতিক অভিযোগ! শত হলেও আমি ওর শিক্ষক, হই না প্রাইভেট টিউটর, তাতে কী? বয়সেও আমি ওরচে’ বারো বছরের বড়ো। এতসব কিছুকে ছাপিয়ে পুচকে মেয়েটা বেফাঁস কথাটা মুখে আনলো কী করে? আরো অবাক লাগছে, এই ড্যাবড্যাবের শব্দটা তিয়া শিখলই বা কোত্থেকে? ও, দুপুরবেলা হোমওয়ার্কের বদলে আজকাল মায়ের সাথে বসে বসে নিশ্চয়ই বাংলা ছবি দেখা হয়!
এমন ড্যাবড্যাব করে তাকানোর কথাটা জীবনে আর কোনো মেয়ের মুখ থেকে আমাকে হজম করতে হয়েছে? মগজের অলিতে-গলিতে দ্রুত উঁকি-ঝুঁকি মারতে সেই স্কুলজীবনে ফিরে যাই। শাওনই ছিলো একমাত্র মেয়ে যে এই কথাটা আমাকে বলেছিলো। বলে ফেলেই টুক করে মিষ্টি হেসে কোমর দুলিয়ে চলে গিয়েছিলো। শাওনের সেই অভিযোগে রস ছিলো, যেই রসে জারিত হওয়া যায়, যেই রসে কেবল চুমুকে চুমুকেই তৃপ্তি, অভিযোগ স্বীকার করে নেয়াতেই আনন্দ কারণ এতে অভিযোগওয়ালারও পূর্ণ সমর্থন আছে। কিন্তু তিয়ার ক্ষেত্রে? ঠিক তার উল্টোটা। ছোটোখাটো কোমল মেয়েটা যে মাত্র সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে, গায়ে এখনো শৈশবের গন্ধ ওর মুখে এমন কমপ্লেন শোনা শিক্ষক হিসেবে আমার জন্য যেমন দারুন লজ্জার আবার কথাটার একেবারে প্রতিবাদ না-করা মানে আমার বেচরিত্র স্বীকার করে নেয়া।
এ-ক থাপ্পড় লাগাবো ফাজিল মেয়ে, বেত্তমিজের মতো কথা! তোমার দিকে আমি ড্যাবড্যাবিয়ে তাকাতে যাবো কেন? চোখ গরম করে ডানহাতের থাবা তুলে মনে মনে তিয়ার কথাটার প্রতিবাদ করি। কিন্তু ও যেমন মেয়ে, বিন্দুমাত্র দমে না-গিয়ে ফস্ করে বলে ফেলতে পারে, এ-হ, নিজে খারাপ করে তাকাবে আবার বললে বলে থাপ্পড় মারবে? মারেন দেখি?
কোনটা যে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকানো আর কোনটা যে নরমাল করে তাকানো দুটোর বিচারকই যেহেতু তিয়া, অতএব সে যা বলবে সেটাই শেষকথা এবং বিচারে তালগাছ ওরই ভাগে। অবশেষে একটা হাঁটুরবয়সী মেয়ের কাছ থেকে ‘চরিত্রহীন গৃহশিক্ষক’ আখ্যা পেতে হবে? উঃ, কী সাংঘাতিক! না না, এ ব্যাপারে ধমকি-ধামকি তো দূরের কথা, কথা বলারই দরকার নাই। এম্নিতেই কথাটা ওর মা’র কানে যায় কিনা সেটা নিয়েই তো এখন ভয় লাগছে। তিয়া তাহলে এবার বড়ো হয়ে গেছে, পুরুষের দৃষ্টির ভাষাও পড়তে শিখে গেছে!
স্যার, এখন কি করবো?
অ্যা? আমি প্রায় চমকে অংক বই থেকে চোখ তুলে তিয়ার দিকে তাকাই। প্রশ্নের উত্তরের জন্য তিয়া আমার দিকে চেয়ে। স্বাভাবিক চাহনি। একটু আগে যে কথাটা বলে আমার বুকের ধড়ফড়ানি ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল করে দিয়েছিলো সেটা যেন ভুলেই গেছে, যেন এটা আর আট-দশটা কথার মতোই সহজ সাদসিধে কথা।
কী হলো, বলেন না কী করবো?
ও, ইয়েÑএই হোমওয়ার্কটাই শেষ করো আগে। কোনোরকমে গলা স্বাভাবিক রেখে জবাবটা দেই।
আচ্ছা। বলে তিয়া বই টেনে নিয়ে করতে শুরু করে।
আমি চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে একটা চাপা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ি। আড়চোখে তিয়াকে দেখি, অংক করছে। ছোট্ট টুনটুনি পাখিটা ছোট্ট হাতে কলম চেপে গুটি গুটি করে খাতায় লিখছে। ওর হাতের লেখা মোটেই সুন্দর না, কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং মার্কা কিন্তু ও যখন লিখতে থাকে আমার দেখতে ভালো লাগে। লেখার সময় ও ঘাড়টা এমন ভাবে বাঁকায়, চোখে থাকে এমন একটা দৃষ্টি, হাত এতো আস্তে আস্তে সুন্দর করে চলতে থাকে যে আমি মুগ্ধ হয়ে তিয়াকে দেখি। ওকে পড়াতে এলে সবসময় আমি চেষ্টা করি কীভাবে ওকে লেখা দিয়ে ব্যস্ত রাখা যায়। ও আবার একদম লিখতে চায় না। পড়াশুনাও যে তেমন একটা করে তা-না। ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে পড়াতে হয়। খালি ফাঁকিবাজির তালে থাকে। আমার জান দফা-রফা করে ফেলে মেয়েটা। মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে যখন বকাঝকা শুরু করি ও ভুরু-চোখ-মুখ কুঁচকে বিদঘুঁটে একটা চেহারা তৈরি করে, গোঁজ হয়ে কথার উত্তর না দিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকে। ওর চেহারা তখন বড়দের মতো রাগি-রাগি হয়ে যায়, নাকের পাটা ফুলে ওঠে। টুনটুনিটা আবার রাগও করতে পারে! উপরে উপরে গলা তুলে ধমকি-ধামকি চালালেও ভিতরে ভিতরে ওর এই ভঙ্গিটা দেখতে আমার দারুন লাগে। আমার খুব ইচ্ছে করে ও তখন প্রেমিকার মতো আমার সাথে ঝগড়া করুক, আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলুক। ঝগড়ার মধ্যেও তো একটা মজা আছে, তাই না? কিন্তু ও একেবারে বোবা সেঁজে থাকে তখন, দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে ঝাঁমটা মেরে একটা কথার উত্তর দেয়।
যা হোক, তিয়া এখন শান্ত হয়ে শতকরার অংকগুলো করছে। কালকে ওর এটার ওপর ক্লাস টেস্ট। দশটা অংক ওকে আগে বহুবার করানো হলেও প্রত্যেকবারই ও সিলি মিসটেক করে দু-তিনটা অংক ভুল করবেই। এর মধ্যে তিয়া দুটো অংক ভুল-ভাল না-করে শেষ করে এখন তিন নম্বরটি শুরু করেছে। আমি জানি আর একটা বা দুইটা শেষ করেই তিয়া ঠাস করে খাতার ওপর কলমটা রেখে চেয়ারে দেহটা সোজা করে বলবে, উহ, হাত ব্যথা হয়ে গেছে, আর করবো না স্যার, সবগুলাই পারি।
আমাকে তখন বলতে হবে, পারলে করে দেখাও।
আরে বাবা, পারি তো, খামাখা করবো কেন?
সবগুলা অংক তুমি একদিনও কারেক্ট করতে পারছো?
তিয়া তখন অকৃত্রিমভাবে হেসে উঠবে, স্বীকারোক্তিপূর্ণ দুষ্টমি ভরা হাসি। হাসলে ওর দুই গালে বিন্দুর মতো টোল পড়ে, অদ্ভুত লাগে দেখতে বড়সড় টোলের চেয়ে এ ধরনের বিন্দুর মতো টোল-পড়া গালের হাসি আরো সুন্দর ও রহস্যময় লাগে। হাসার সময় তিয়ার দুই কাঁধ খানিক উঁচুতে উঠে যায়, বুকও ওঠে পুরো দেহেই কয়েক সেকেন্ড মৃদু কাঁপুনি চলে। আমি তখন চোখেমুখে একটা রাগের নকল-ভাব এনে ওর দিকে তাকাই। আমি রেগে যাচ্ছি দেখে তিয়ার হাসিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়, ও মজা পায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওর এই হাসির জন্য আমি যে পিপাসার্তের মতোই অপেক্ষায় থাকি ছোট্ট টুনটুনিটা এটা জানে না। এমন হাসির সময়েই ছোট্ট টুনটুনিটার কুঁড়ির মতো দুটি বুক ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ওঠা-নামা করে। সেই মুর্হর্তে সেদিকে অবশ্য আমি আঁশ মিটিয়ে তাকাতে পারি না কারণ তিয়ার চোখ থাকে আমার দিকে। আমি কেবল আঁড়চোখে কোনরকমে একবার দৃষ্টিটা সেদিকে ঘুরিয়ে এনেই জোরে ধমকে উঠি, থামো।
তিয়া থেমে যায়, সাথে সাথেই থেমে যায়।
করো, সবগুলা শেষ করো। আমি গম্ভীরস্বরে আদেশ দেই।
আমি সবগুলাই পারি, শুধু শুধু কষ্ট করতে পারবো না।
সবগুলা করে তারপর বলো পারি।
আমি সবগুলা করবো না, ব্যস।
আমি বলেছি তোমাকে সবগুলা করতে হবে, তুমি করবে।
তো প্রায়ই পড়া নিয়ে এরকম টানাটানি চলে। মাঝে মাঝে আমি জিতি, মাঝে মাঝে তিয়া। কখনো কখনো মনে হয় আমি না তিয়াই আমাকে পড়াচ্ছে। তিয়ার ওপর জোর খাটিয়ে কাজ করানো খুবই কঠিন মামলা। মেয়ে মানুষ, গায়ে হাত তোলারও উপায় নেই। তার উপর বাপের পেয়ারের কন্যা। বাপ থাকে অ্যামেরিকায়, বাপের কড়া নির্দেশ মেয়েকে পেটানো যাবে না। কী আর করা? মায়ের কাছে বিচার দিয়ে আর ধমকি-ধামকি-রাগারাগি করে যতটুকু চালানো যায়, সেভাবেই চলছে। ইদানীং আবার তিয়াকে নিয়ে আমার অন্য টেনশনও হচ্ছে। সেদিন বললো, ওই পাশের বিল্ডিংটার একটা ছেলে নাকি ওকে দেখতে পেলেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে মিটিমিটি হাসে। শুনে আমার মাথা দিয়ে আগুন বেরুচ্ছিলো, যৌবনের বাতাস মাত্র লাগতে শুরু করেছে তিয়ার গায়ে, এখনই এরকম হলে কদিন পরে তো…, আমার নিশ্বাস আটকে আসছিলো, জিজ্ঞেস করলাম, আর তুমি? তিয়া খিলখিল করে হেসে উঠলো, আমি আবার কী করবো? বাধ্য হয়ে ঘরের জানালা বন্ধ করে দেই।
আমি ঘড়ি দেখি। আধাঘণ্টা হয়েছে পড়াতে এসেছি। আর বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই তিয়ার মা নাস্তা নিয়ে আসবে। আজকে সম্ভবত নুডুলস্। খানিক আগে অফভয়েসে শোনা গেলো, কাকে যেন নুডুলস্ আনতে পাঠানো হচ্ছে। ভালোই, নুডুলস্ আমার পছন্দের একটা খাবার আর তিয়ার মা’র হাতে বানানো নুডুলস্ তো অসাধারণ, বাংলাদেশে আর কোথাও আমি এতো ভালো নুডুলস্ খাইনি। একদিন সুযোগ বুঝে এ-কথাটাই তিয়ার মাকে বলতে তিনি খুশি হয়েছিলেন এবং এর পর থেকে দেখা গেলো নাস্তা হিসেবে ঘন ঘন নুডুলস্ আসছে।
আমি আবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। পাঁচটা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। অপরাজেয় বাংলার সামনে পাঁচটা বাজে মিলা আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তিয়াকে শেষ করে সিএনজি-তে গেলেও বিশ মিনিট লেট হয়ে যাবে। কমপক্ষে একঘণ্টা না-পড়িয়ে চলে যাওয়া খারাপ দেখায়। অবশ্য তিয়া একঘণ্টার বেশি পড়েও না। আমি বেশি সময় দিতে চাইলেও কাটায় কাটায় একঘণ্টা পার হলেই মেয়েটা উসখুশ শুরু করে। তারপর হোমওয়ার্কের খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, নেন স্যার, হোমওয়ার্ক লিখে ছুটি দ্যান।

সিএনজি করে ইউনিভার্সিটির অপরাজেয় বাংলার সামনে যখন এসে পৌঁছলাম তখন সাড়ে পাঁচটা। ঝকঝকে বিকেল চারপাশে ছড়ানো। মিলা একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের নীচে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ওর মুখের কঠিন ভঙ্গি। আমি গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে অপরাধীর মতো ওর পাশে বসে বললাম, সরি। মিলা কটমট করে তেরছা চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে পলকে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললো।
চটে আছে মিলা। চটারই কথা। শুক্রবার ও ছায়ানটে গান শিখতে আসে। গানের ক্লাস শেষ হয় পাঁচটা বা পাঁচটার আগেই। এতোক্ষণ শাড়ি পড়া একটা সুন্দরী মেয়ের জন্য একা একা অপেক্ষা করা মোটেই সুখকর কাজ না।
আই, শোনো না বাসায় গেস্ট আসছিলো তো, বের হতেই দেরি হয়ে গেছিলো। আমি আস্তে আস্তেকৈফিয়ত দেয়ার সুরে বলতে থাকি কিন্তু মিলার মুখ এইদিকে ঘোরে না। আমি কণ্ঠে আদুরে ভঙ্গি আনি, কী করবো বলো? ওই টিউশনিতেও-তো একঘণ্টার নীচে পড়ানো যায় না। শুক্রবারসহ তিনদিন মোটে পড়াই।
কথা আর শেষ করা হয় না, মিলা গরম-চোখে তাকিয়ে ছ্যাৎ করে ওঠে, টিউশনিটা তুমি ছেড়ে দিতে পারো না? দরকার কী তোমার টিউশনির? সপ্তাহের একটা দিনও আমারে সময় দিবা না?
তিয়াকে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে পড়াচ্ছি। স্বভাবমতো যত্ন নিয়ে পড়ানোয় প্রথম পরীক্ষায় ভালো করে। ভালো টিচার হিসেবে আমার একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়। অংকে বহুকষ্টে পঞ্চাশ পাইয়ে ওকে সিক্সে উঠাই। এদিকে আমারও মাস্টার্স শেষ হয়ে যায়। এখন ছয় মাস হলো একটা মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করছি। সাড়ে সতেরো হাজার টাকা বেতন। আমার চাকরির সুখবরটা শুনে তিয়ার মা হাসিমুখে বলেছিলেন, ভালোই তো। ..অফিস-টাইম পাঁচটা পর্যন্ত? তাহলে আর অসুবিধা কী? তুমি তো আসো সন্ধ্যার পরে। কষ্ট করে হলেও আমার মেয়েটাকে তুমি পড়াও বাবা, দরকার হলে একদিন কম আসো। ছোট্ট টুনটুনিটাকে ছেড়ে আমিই কি যেতে চাই? চাকরির কথাটা বলে নিজের একটু দাম বাড়িয়ে নিলাম আর-কি। মাস শেষে দেখা গেলো চারদিনের জায়গায় তিনদিন পড়ানোর পরেও বেতন পাঁচশো টাকা বেড়ে গেলো।
আমি কাঁচুমাঁচু মুখে উত্তর দেই, অনেকদিন ধরে টিউশনিটা করাই, একটা ভালো রিলেশন হয়ে গেছে। ..চাকরি পেয়েতো ছেড়েই দিতে চাইছিলাম.., তাছাড়া বেতন আর টিউশনির টাকাটা মিলে একটা রাউন্ড ফিগার বিশ হাজার টাকা আসে।
কথাটা বলে আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলাম, মিলা আমার দিকে তীক্ষ্মচোখে চেয়ে হঠাৎ ক্ষেপে যায়, বাজে কথা না-বলে সত্যি কথাটা বললেইতো পারো? বলতে পারো না তুমি ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ছো?
তিয়াকে জড়িয়ে মিলা এমন একটা কথা বলবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। মেয়েদের কি ঈগল-চোখ? মনের ভিতরটাও দেখে ফেলতে পারে? মিলার কাছে কি আমার অবচেতন মনের কোনো আচরণে ধরা পড়েছে তিয়ার প্রতি আমার দুর্বলতা? হঠাৎ বুকের ভেতরটা ফাঁকা মাঠের মতো শূন্য লাগে, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এই প্রথমবারের মতো মিলার চোখের দিকে তাকাতে সংকোচ লাগে। মিলা তো মিথ্যে বলেনি, আমি বোধ হয় তিয়ার প্রেমেই পড়ে যাচ্ছি। দেখার প্রেম। তিয়াকে আমার কেবল দেখতেই ভালো লাগে, এছাড়া অন্য কোনো ব্যাপার নেই। ও যখন বইখাতা বুকে চেপে আমার কাছে পড়তে আসে, চেয়ারে এসে বসে কী অদ্ভুত সুন্দরভাবে যে তিয়া হেঁটে আসে! ছোটোখাটো টুনটুনিটা ছন্দের তালে তালে যেন হাঁটে, আমি দেবীর দৃষ্টিতে ওকে দেখতে শুরু করি, কারণ আমার দেখা শুরু হয় পা থেকে। আমি দেখি ছোট্ট দুটি কোমল পা আমার দিকে এগিয়ে আসছে..।আমি অপেক্ষায় থাকি ও কখন পড়ার মাঝে কোনো অজুহাতে উঠে অন্য ঘরে যাবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো ওর 

প্রসারমান সদ্য কিশোরী-নিতম্বের-নিতম্বের উল্লাস, ওর কাঁধের ওপর নেমে আসা চুলের গোছার নাচানাচি। হ্যাঁ, আমি কেবল ওকে দেখতেই ভালোবাসি, শুধু চোখভরে দেখতে আর কিচ্ছু না। এটাকে প্রেম বলা যায় কিনা আমি জানি না। মনে পড়ে স্কুলজীবনে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওর পাশের বাড়ির মেয়েটির নামের প্রেমে পড়েছিলো। বন্ধুটি সমস্ত বই-খাতা-ডিকশনারি-টেবিলে এমনকি ওদের ঘরের দেওয়ালের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত মেয়েটির নাম লিখে লিখে ভরিয়ে ফেললো। আমি যতোই ওকে বলি, তুই মেয়েটার প্রেমে পড়েছিস। ও বলে, না, ওর নামটা আমার ভালো লাগে তাই লিখি। এর দুই বছর পর শুনলাম, বন্ধুটি ততোদিনে মেয়েটির গভীর প্রেমে তলিয়ে গেছে। আমার ক্ষেত্রেও কি সেরকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে?
আমি হতভম্ব গলায় বলি, তু-মিÑ, কী বলছো এসব? একটা বাচ্চা মেয়ে, মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে! ওকে নিয়ে ছিঃ, এতো ছোটো মনের তুমি!
মোটেই দমে না গিয়ে মিলা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, তাহলে তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছ না কেন? তোমার সমস্যাটা কোথায়? বলো আমাকে?
আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে মিলা তখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। একই ডিপার্টমেন্ট। মাস্টার্সে এসে কিভাবে কিভাবে যেন ওর সাথে হয়ে গেলো। চাকরি পাওয়ার পরপরই মিলা বললো, এবার আস্তে আস্তে বিয়ের প্রস্তুতি নাও, বাসা থেকে আমার বিয়ে দিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। চাকরি পাওয়ার পর ফ্যামিলিও আমার বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী। আমাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি। বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন, তার আগেই মাথা গোঁজার জন্য একটা দোতলা বাড়ি করেছেন, একমাত্র বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফাঁকা। মা-বাবা চাচ্ছেন ঘরে বউ আসুক। মিলাকে সে কথা বলেছিও। কিন্তু তার মানে এই নয় যে খুব শিগগিরই আমাদের বিয়ে করতে হবে। এতো তাড়াহুড়ার কি আছে? তাছাড়া বিয়ে করে ফেললে ছোট্ট টুনটুনি পাখিটার কি হবে? ওকে নিশ্চয়ই আমি আর পড়াতে পারবো না? এ-কারণে বিয়ের কথাটা আসলেই মনটা কেমন আকুলি-বিকুলি করে, ছোট্ট টুনটুনির দুষ্টমিভরা মিষ্টি মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ওকে না-দেখে আমি থাকবো কি করে? কিন্তু মিলাকে আমি সত্যিকারের ভালোবাসি, ওর দিকে তাকাই আমি উপর দিক থেকে যে দৃষ্টিতে কাম থাকে। এই যে প্রতি শুক্রবারে মিলা শাড়ি পরে আসে, আমি ফাঁকে-ফোঁকড়ে সুযোগ বুঝে চোরা-চাহনি দিয়ে ওর উন্মুক্ত পেটের গোল চাঁদটি দেখার চেষ্টা করি, আর ভাবি বিয়ের পর সেই গোলকের সুরা আমি অঢেল পান করবো। আমি মিলাকে পেতে চাই তবে ওই টুনটুনি পাখিটাকেও যে দেখতে চাই! টুনটুনিকে কেবল দেখতেই চাই, পেতে না।
তুমি এসব কি উলটা-পালটা কথা বলতেছো? বিয়ে করতে চাইবো না ক্যান? আমি অধৈর্য হয়ে মিলার মুখের দিকে তাকাই।
মিলার গাল লাল হয়ে গেছে, মুখ যেন তিরতিরিয়ে কাঁপছে। মিলা রাগ সামলাতে চেষ্টা করে বলে, কেন চাচ্ছো না সেটাই তো জানতে চাচ্ছি?
আমি বোঝাতে চেষ্টা করি, দ্যাখো, বিয়ে তো কোনো ঘটনা না, করলেই করে ফেলা যায়। কিন্তু তোমার অনার্সটা কমপ্লিট করে নিলে ভালো হয় না? বিয়ের পর পড়াশুনায় ঢিলামি এসে যায়। ..আমি চাচ্ছিলাম তোমার অনার্সটা শেষ হোক আর এই ফাঁকে হাতে কিছু টাকা-পয়সা জমাইÑ
আমার বাসায় আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না। আমি বলে বলে এতো দিন রাখছি। তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো। মিলার গলা এতক্ষণে প্রায় স্বাভাবিক শোনায়। একটু থেমে বলে, আজকে সকালে ফুফু এসে বলতেছে, একটা ডাক্তার ছেলে পাইছে, ওদের নাকি সামনের শুক্রবারে দেখাতে নিয়ে আসবে।
শুনে বুকটা ধরাস করে ওঠে। বলে কি? কোথাকার কোন ডাক্তার-মাক্তার এসে আমার মিলাকে গরু দেখার মতো করে দেখে যাবে? বুঝেছি, এই জন্যই মিলার মেজাজ আজকে এতো চড়া। তাই তো বলি আসতে না-আসতেই আজকে আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন? তিয়াকে নিয়ে ও-কথাটা মিলা তাহলে আমাকে রাগানোর জন্য বলেছে, যাতে কথটাকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আমি তড়িঘড়ি বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। আসলে ও কিছু বুঝতে পারে নি। যাক, বাঁচলাম। মিলা এম্নিতে শান্ত মেয়ে, তবে সেন্টিমেন্টাল হওয়ায় রেগেও যায় দ্রুত। বাট শি ইজ রিয়েলি আ গুড গার্ল। মাস্টার্সে পড়ার সময় বেশিরভাগ দিনই আমার ক্লাস শুরু হতো সকাল আটটায়। সেসব দিনে মিলা আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসতো। কারণ ক্লাস ধরতে ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা না খেয়ে আমি ইউনিভার্সিটি দৌড়াতাম। ক্লাস শেষে ডাকসু বা আইবিএ ক্যান্টিনে বসে মিলার আনা নাস্তা খেতাম। কলা, সিদ্ধ-ডিম, সাদারুটি। অনেকেই তখন আমাদের দিকে কৌতূহলী-চোখে তাকাতো। আমার লজ্জা লাগতো, মিলাকে বলতাম, ধুর, তুমি আর নাস্তা এনো নাতো, মানুষ তাকিয়ে থাকে। মিলা সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করতো না, বলতো, ওরা তাকায় কারণ ওরা মনে মনে আফসোস করে ওদের প্রেমিকারা কেউ কষ্ট করে ওদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে না। নাস্তা ছাড়াও মাঝে মাঝে মিলা বাসা থেকে নুডুলস্, পিঠা, পুডিং, এটা-সেটাও নিয়ে আসতো। সত্যিই মিলা চমৎকার একটি মেয়ে। এমন একটি মেয়েকে ভালোবাসতে পেরে এবং ভালোবাসা পেয়ে সত্যিই আমি গর্বিত।
কি, চুপ করে আছো যে?
একেবারে শান্ত স্বাভাবিক গলা মিলার, যে গলায় সবসময় আমার সাথে কথা বলে।
আমি চোখ তুলে দেখি মিলা আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে। একটু আগ পর্যন্ত যে মেয়েটা আমার সাথে কড়া কড়া কথা বলছিলো সে যেন অন্য কেউ। আমিও ওর চোখে খানিক তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি আনার চেষ্টা করি, শ্বাস ফেলে বলি, হু, ভাবছি।
মিলা এবং মা দুদিক থেকেই এখন বিয়েটা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কাল রাতে খাবার সময় মা আমাকে উদ্দেশ্য করে সগতোক্তির মতো বলছিলো, কবে পোলায় বিয়া করবো আর কবে নাতি-নাতকুরের মুখ দেখমু, এর আগেই না-জানি কবরে যাইতে হয়!
দাঁড়াও দাঁড়াও, কয়টা দিন ওয়েট করো মা, বিয়া তো করবোই, তারপর দেখবা নাতি-নাতকুরে ঘর ভরে গেছে। মশকরাটা করতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছিলাম। শুধু মনে মনে হাসছিলাম। কিন্তু বিয়ের কথাটা ভাবলেই যে টুনটুনির মুখটা মনে পড়ে যায়। বুকটার মধ্যে হু হু করে ওঠে। না না, টুনটুনির প্রতি আমার অন্য কোনো আকর্ষণ নেই, শুধু দেখার আকর্ষণ। এখানে হয়তো ফ্রয়েডকে হাজির করে বলা যেতে পারে, তিয়ার প্রতি আমার আকর্ষণ চেতন মন থেকে অবদমিত হয়ে নির্জ্ঞান মনে অবস্থান করছে। স্কুলে পড়াকালীন একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগতো। ছাদে উঠে প্রায়ই আমি ওকে দেখতাম। একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম বিছানায় আধশোয়া হয়ে আমরা পরস্পরকে আদর করছি। এবং অবাক কাণ্ড সেই বিছানারই কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মেয়েটার বাবা-মা, তারা আমাদের দিকে পিছন ফিরে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে টিভি দেখছে। নির্লজ্জের মতো তাদের সামনেই আমরা যে এমন একটা কাজ করছি এতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নাই যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা এবং তাজ্জব ব্যাপার, আমার কাছেও বিষয়টাকে মোটেই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আজো এ স্বপ্নের কথাটা মনে হলে আমি মনে মনে হেসে উঠি। ফ্রয়েড মিয়া অবশ্য বলেছেন, আমাদের নির্জ্ঞান মনে অবস্থান করা অবদমিত আবেগ বা ইচ্ছাগুলো ঘুমের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার চেষ্টা চালায় আর সেগুলোকেই আমরা স্বপ্ন বলি। আরে ধুর, এইসব ফ্রয়েড-ম্রয়েডের তত্ত্ব ভাবলে মাথাটা উলটা-পালটা লাগে। নির্জ্ঞান মনে কি আছে ওইসব জানার দরকার কী? আমার স্বপ্নের মধ্যে মিলার সঙ্গে তিয়া যদি জোর করে ঢুকেই পড়ে তো আমি কী করবো? ওইসব জানাজানির মধ্যে আমি নাই। আমি জানি টুনটুনিটারে আমি প্রাণভরে দেখতে চাই আর মিলারে শরীর-মনে পেতে চাই, ব্যস। কিন্তু একজনকে পেয়ে আরেকজনকে তো হারাতে চাই না! ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবতে থাকি, প্রতিবারের মতো ভাবনায় কেবল তলিয়ে যাই, ভাবনার আর তল খুঁজে পাই না।
কি হলো? তোমার জবান বন্ধ হয়ে গেলো নাকি? মিলা রসিকতা করে। আমার হাত টান দিয়ে বলে, চলো তো হাঁটি। বসে বসে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেলো।
আমি চাপা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াই, চলো।

অক্টোবর’০৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *