Uncategorized

এডিনব্রা’র একটি বিকেল

মাশা ভ্লাদিমিরার কথা জিজ্ঞেস করে। নিকের একটু অস্বস্তির অনুভূতি হয়। নিক, মানে নিখিলেশ- নিখিলেশ পোদ্দার। কয়েক বছর ব্রিটেনে থাকার সুবাদে নামের এমন ‘ শর্ট, সুইট ও স্মার্ট’ ইংলিশ ভার্সন। নিক বিয়ারে মৃদু চুমুক দেয়। মাশা পানির গ্লাসে। বারটার বেশি বাজে। রেস্টুরেন্ট এখনো পুরোটাই ফাকা। ওয়েস্টার্ন কিংস ম্যানর হোটেল থেকে বেরুলে ডানের রাস্তাটা পোর্টওব্যালো বিচের দিকে গেছে। সেদিকেই হাঁটছিল দুজন। পথে এই হাত-পা-ছড়িয়ে বসার মত এলাহি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়ে। জানালার পাশে একটা টেবিলে গিয়ে বসে। ঢোকার সময়ই চোখে পড়ে মাত্র দুজন কর্মচারী- দুজনেই গ্লাস পলিশ করছে। একজন স্কটিশ (ম্যানেজার নিশ্চয়ই), অন্যজন এশিয়ান। একটু বাদে খাবারের অর্ডার নিতে আসলে এশিয়ান ছেলেটির একসেন্টে ধরা পরে সে ইন্ডিয়ান।
বাদামি চামড়ার পাশে সাদা চামড়া দেখে ইন্ডিয়ানরা যতটা অভ্যস্ত, বাংলাদেশিরা না। তারা লম্বা চোখে তাকায়। সেখানে থাকে ঈর্ষা। নিকের অবশ্য এতে ভালোই লাগে। আরো ভালো লাগে যখন কোনো ব্রিটিশ তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি এখানে জন্ম? উত্তরে ‘বাংলাদেশ’ শুনে তাদের চোখ বড় হয়ে যায়, ইউ গট আ পারফেক্ট একসেন্ট। এই পারফেক্ট একসেন্ট দিয়েই সে কখনো কখনো বাঙালিদের বোকা বানায়। হয়তো রাস্তায় একজন জিজ্ঞেস করলো, আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ? নিক তখন ছোট্ট হেসে জানায়, আ’ম ফ্রম মরিশাস। কাজটা সে ইচ্ছে করেই করে।
বিদেশে এসে একটা জিনিস সে বুঝেছে। স্বজাতি ভাইদের থেকে যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল। কারণ এরা নিজেদের ভিতর মারামারি, দলাদলি নিয়েই আছে। কোনো এক বাঙালি উপরে উঠছে দেখলে সবাই মিলে যুদ্ধে নামে কিভাবে তার পা টেনে নিচে নামানো যায়। এদের কাছে শেখার কিছু নাই। অনেকে আবার এখানে এসে ধার্মিক হয়ে যায়। মদ ছোবে না, বার-এ কাজ করবে না। ইংলিশ কালচার খারাপ। এদের মেয়েরা আরো খারাপ। বিয়ে-শাদি করে না, বাস্টার্ড বাচ্চা জন্ম দেয়। আরে এতই যদি খারাপ তো এই ইংল্যান্ডে আসার দরকার কি? খাবি এদের দেশে, পরবি এদের দেশে, আবার এদেরকেই বলবি বেজাত-বেজন্মা। বাঙালি স্রেফ এক নিমকহারাম জাত। নিজের বাদামি চামড়ার জন্য নিকের দুঃখ হয়। আরেকটু ফর্সা হলে তাকে ইউরোপিয়ান বলে চালিয়ে দেয়া যেত। যাহোক, কি আর করা! এই সস্তা বাঙালপনা বাদ দিয়ে নিক এখন এডিনব্রা দেখে, মাশাকে দেখে।
চমৎকার আবহাওয়া আজ। হাল্কা মিষ্টি রোদ। জানালা দিয়ে মাশার চুলেও রোদের ছটা পড়েছে। ব্লন্ড চুল নিকের ভাল লাগে। তবে ওর চুল সাদাটে ব্লন্ড। বেশিরভাগ ইস্ট ইউরোপিয়ানের যেমন হয়। রাশান হিসেবে বেশ খাট মাশা। ওর মুখের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল- ভুরু নাই। ভুরুর জায়গাটাতে সবসময় আইব্রাও পেন্সিলের টান। আজ মাশার জন্মদিন। সে উপলক্ষেই দুদিনের ট্রিপে স্কটল্যান্ড আসা। হোটেলের ক্যাফেতে কাল সন্ধ্যায় জন্মদিনের ডিনার হল; শ্যাম্পেনসহ। খেয়েদেয়ে রুমে ফিরে একটু কুইক-সেক্স। এবং ঘুম।
এডিনব্রায় নিকের আসার কথা ছিল না। ছিল মাশার স্লোভাকিয়ান বন্ধু মনিকার। এসব দেশে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে যা হয়- শেষটা বন্ধুত্বে এসে ঠেকে। মাশার সঙ্গেও তাই। বড়জোর অনলাইনে হাই-হ্যালো বা মোবাইলে টেক্সট। তাছাড়া দুজনের কেউই এখনো নতুন কোন সম্পর্কে জড়াতে পারেনি। অতএব ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস’ (শারীরিক সম্পর্ক) ব্যাপারটা চলতেই পারে। এমনই একদিন মাশা বলল ওর বাসায় যেতে। ওর ফ্লাট-মেট কাম ইরানি হাজব্যান্ড ইরাজ এখন ছুটিতে দেশে গেছে। যাই-যাব করে একদিন সন্ধ্যায় নিক গেল মাশার ব্রিক্সটনের ফ্লাটে।
‘আজ থাকছ তো?’
‘হু। কিন্তু ভোররাতে উঠে কাজে যেতে হবে।’ নিক জানায়।
এক বেডের কাউন্সিল ফ্লাট। মাশা থাকে ড্রয়িংরুমে। ওর হাজব্যান্ড বেডরুমে। কাগজে-কলমে তাদের এখনো পুরোপুরি ডিভোর্স হয়নি। এ নিয়ে আইনি কাজ এগুচ্ছে। কয়েক বছর যাবতই তাদের সম্পর্ক নেই। মাশার আয় যৎসামান্য এবং চাকরি অনিশ্চিত। তাই একা ফ্লাট নিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই। ‘ফুড ফর ওয়ার্ক’ গোছের একটা অলিখিত চুক্তি আছে লোকটার সাথে- বাড়িভাড়া কিছু শেয়ার আর বাসা পরিষ্কার রাখে। ডেভিড ক্যামেরুনের সরকার এসে সব বেনেফিট কমিয়েছে। তাছাড়া, মাশার কাগজপত্রের কিছু জটিলতার কারণে সে সোশ্যাল বেনেফিটের জন্য আবেদনও করতে পারছে না।
ইরাজ লন্ডন থেকে ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনারে রাশিয়া যায়। সেখানেই পরিচয়, ভাল লাগা এবং বিয়ে। আর লন্ডন ফিরে আসে মাশাকে সঙ্গে নিয়ে। ইরাজ একাই এদেশে। ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেয়েছে। লন্ডনের বাইরে একটা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ায়। মাশা কখনো শ্বশুরবাড়ি মানে ইরান যায়নি। সঙ্গত কারণেই কেউ তাকে স্বাভাবিকভাবে নেবে না। মাশার ভাষায়, ইরাজ ভয়ানক বদরাগী, যা তা ব্যবহার করে, চুন থেকে পান খসলেই হাত চালাতেও দ্বিধা করে না, লোকটা যতক্ষণ বাসায় থাকে ভয়ে তটস্থ থাকে সে। আর ভাল গুণ বলতে ইরাজের মধ্যে একটাই- মাগিবাজ নয়। গায়ে হাত তোলা বন্ধ হয় পুলিসের কাছে একবার রিপোর্ট করার পর। পরিণামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজের চাকরি যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।
একটা ব্যাপার বুঝতে নিকের কিছুটা সময় লেগেছে। এতো অল্পসময়ের পরিচয়ে মাশা ইরাজকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো কেন? নান্দনিক শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ-এ স্কুলশিক্ষিকা মাশাকে চাকরি আর প্রাইভেট টিউশনিতে সকাল থেকে রাত অব্দি পরিশ্রম করতে হত। মাশার মা ইহুদি, বাবা ক্রিশ্চিয়ান। নিজ দেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের শিকার তাকেও হতে হয়েছে। মাশার মুখে কয়েকবারই শুনেছে, ‘আই হেইট দ্যাট কান্ট্রি।’
ওয়েটার খাবার নিয়ে আসে। স্যামন মাছ, চিপস, অনিওন রিঙস আর সালাদ।
‘ভ্লাদি স্লোভাকিয়ার মেয়ে। হিলটন হোটেলে কাজ করতে গিয়ে পরিচয়। চমৎকার মেয়ে। অল্পকদিনেই মনে ধরে যায়। একদিন অনলাইনে ফুলের বিজ্ঞাপন দেখে কি মনে হল- ফুলের তোড়া কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেই ভ্লাদিকে। বাড়ির ঠিকানা যেহেতু অজানা, হোটেলের ঠিকানায় দিলাম। পরে ফেইসবুকে চ্যাটের সময় স্বীকার করলাম যে আমিই ফুল পাঠিয়েছি।’ খেতে খেতে ভ্লাদির ব্যাপারটা মাশাকে সব খুলে বলে নিক। ‘কিন্তু বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। তাই না?’ মাশার দিকে তাকায় সে।
‘না, ঠিক আছে।’
‘একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি, জানো? ওর নামে গুগলে সার্চ দিয়ে এক জায়গায় ওর অনেক তথ্য পেয়েছি। ও ম্যানচেস্টারে অ পেয়ারের (বাচ্চা দেখাশুনার) কাজ করত। চ্যাটের সময় আহাম্মকের মতো বলে ফেলেছি ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি এবং বলেছিও কিছু। কিন্তু কিভাবে জেনেছি তা বলিনি। পরে মনে হল কাজটা ঠিক হয়নি।’
‘হুম। তুমি জেনেছ ভাল কিন্তু শুরুতেই সেটা ফাস করা উচিৎ হয়নি।’
‘আসলে, এখানে কালচারালগত একটা ব্যাপার আছে- যেটা আমি বুঝিনি। আমাদের দেশে এমন করলে মেয়েটা ভাবত, আহা, আমাকে কত গুরুত্ব দেয়, কত কাঠখড় পুড়িয়ে এসব জেনেছে। আর এখানে ঠিক উল্টা- কারো অজান্তে তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি অপরাধের মতন। ভ্লাদি হয়ত আমাকে এখন স্টকার ভাবছে।’
‘মেয়েটার সাথে কথা বলে তাই মনে হয়েছে?’ মাশা জিজ্ঞেস করে।
‘কাজে কথা বলার তো তেমন সুযোগ নেই। চ্যাটিঙের সময় ওর ভাবটা এমনি মনে হয়েছে। এখন কি করি বলতো, আমি সত্যি ওর প্রেমে পড়েছি।’
মাশা নিকের দিকে তাকায়, হাসে। ‘হতাশ হয়ো না রোমিও, চেষ্টা করে যাও, দেখ কি হয়।’ কিছুক্ষণ জানালার পাশের চেরি গাছটার দিকে তাকিয়ে মাশা বলে, ‘তাও তো তোমার একটা পথ হল, আমার কি হবে বলতো, নিক। কাল রাতে শাহ এর টেক্সট পাওয়ার পর থেকেই মনটা কেমন করছে। অনেকদিন যোগাযোগ নেই কিন্তু আমার জন্মদিন ও ঠিকই মনে রেখেছে।’
‘তুমি এখনো ওকে ভালবাস, তাই না?’
‘বাসি।’ মাশার ছোট দীর্ঘশ্বাস। ‘দেখ, প্রতিটা সম্পর্কই একটা পরিণতি চায়। শাহ এর সাথে আমার সম্পর্কটা এক জায়গায় আটকে ছিল। তাছাড়া শাহ ভয়ঙ্কর ডিপ্রেশনে ভোগে। ওর শৈশব কেটেছে অনিশ্চয়তায়। বাবা পাকিস্তান থেকে বউ ছেলেমেয়ে লন্ডনে এনে নিজে উধাও হয়ে যায়। পরিবারের আর কোন খোঁজখবর রাখেনি। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে বড় হয়েছে ওরা। শাহ সবার বড়। বাকি এক ভাই আর বোনটি কিছু করে না। মাসহ সবাই একসাথে থাকে এবং ওকেই সংসার চালাতে হয়।’
‘কি বল, এই সময়ে এসে একথা তুমি বিশ্বাস করতে বলছ, মাশা? সবাই শাহ এর ঘাড়ে বসে খায়?’
‘বাকিরা হয়ত সরকারি বেনিফিট খায় কিন্তু ঘরের মূল আয়ের মাথা অই একজনই।’
‘আশ্চর্য। আচ্ছা, শাহ এর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে কখনো তোমার?’
‘পাগল! হার্টফেল করে মারা যাবে সে- টিপিকাল পাকিস্তানি মুসলিম মহিলা। সে বেঁচে থাকতে আমাদের একসঙ্গে থাকাও অসম্ভব। এজন্যই তো সম্পর্কটা-’ মাশার গলা ধরে আসে।
এতোটা ইমোশনাল হতে কখনো দেখেনি মাশাকে নিক। ফর্সা মুখটা হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেছে। ওর হাতের পিঠে আঙ্গুলের মৃদু চাপ দেয় নিক। মাশা টিস্যু দিয়ে চোখের কোণ মোছে। ‘শাহ নিজের একটা জগতে থাকে। লেখালেখি করে- গীতিনাট্য লেখে। চটি বই আকারে ওগুলো প্রকাশও করেছে। লেখালেখি আর অই মা- এই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। নয়ত এতদিন হয়ত আত্মহত্যা করে বসত।’
‘ডিপ্রেশন খুব বাজে জিনিস-’ নিক মাথা নাড়ে।
‘শাহকে নিয়ে আমি ক্লান্ত। তাও যদি সম্পর্কের একটা ভবিষ্যৎ থাকত। তুমি শুনলে অবাক হবে- ও যখন বাসায় থাকত পারতপক্ষে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলত না- যদি বাসার কেউ বুঝে ফেলে।’
‘অবিশ্বাস করছি না তোমার কথা। ইংল্যান্ডে অনার কিলিং তো পাকিস্তানিরাই করে।’
‘সবকিছুর পরেও শাহ এর সঙ্গে আমার অনেক সুন্দর সময় কেটেছে, জানো। আমরা কত জায়গা ঘুরে বেরিয়েছি। কত হোটেলে দিন পার করেছি।’ মাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। খাওয়া শেষ হয়েছে আগেই। ড্রিঙ্কসে চুমুক চলছে। নিক জানালায় তাকিয়ে। বাইরে কি নরোম বিকেল। অথচ ভিতরে কেমন দম-বন্ধ লাগছে। মাশা যেন বুঝতে পারে।
‘আচ্ছা, আমরা কি করছি বলতো? ঘুরতে এসে এইভাবে মনমরা থাকলে হবে? শহরটাতো এখনো ভালমত দেখাই হল না। চল চল, উঠি। বিচে আর যাওয়া সম্ভব না। এখানে বাসের জন্য যা ওয়েট করতে হয়।’
‘হ্যাঁ, চল।’
রেস্টুরেন্ট ততক্ষণে লাঞ্চের জন্য বেশ সরগরম। দুজন বের হয়। রেস্টুরেন্টের সামনে বিচে যাওয়ার রাস্তাটার দিকে তাকায়- একদম সোজা চলে গেছে। ওদিকে গেলে আর শহর দেখা হবে না। আজ রাতেই লন্ডন ফিরে যাচ্ছে তারা। এখান থেকেই বহুদূরের সাগর আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে। চারদিক নীল আর নীল।
‘অদ্ভুত সুন্দর না?’
‘হ্যাঁ।’ নিক মাশার হাত ধরে।

শ্রাবণ ১৪১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *