গল্প, বাংলা

ওড়ার স্বপ্ন

‘শইলের ত্যাজ তোর কয়দিন, ঢইল্যা গেলেই সব শেষ ! নিজে তো মাজা ভাইঙ্গা বছর ধইড়া পইড়া রইছি ; বন্যায় মাইনষের ধান-পান সব গেল, তোরে কামের লেইগা কেডা ডাকব ? শইল ঠিক থাকলে আমিও মাইনষের লাহান ঢাহা যাইতাম কাম করতে, কয়ডা ভাতের লেইগা মাইনষের চেট দোয়াইতাম না।’ আক্ষেপ আর নিচু গলায় কথাগুলো বউ-এর উদ্দেশে বলে চলে আমের আলী।
তার বউ বনির মুখে রা নাই দেখে আমের আলী খানিক চুপ থাকে, তারপর অপরাধী-কণ্ঠে বলে, ‘আইজ আইব, তুই না-করিস না। এই বন্যাডায় আলাউদ্দি না থাকলে আমরা বাঁচতাম ? আপদে-বিপদে সাহাইয্য করছে।’
বনি নিশ্চুপ, তার চোখে সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়া। শূন্য চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে দূরের আসমানে।
রাশি রাশি ছায়া নদীতীরের গ্রামটিকে জাপটে ধরেছে। দিনটা আজকে খুব গুমোট গেছে, বাতাস নেই। ভূত-অন্ধকারে দীঘির বটগাছটিকে খুব রহস্যময় লাগে। বছরের পর বছর নির্জন মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। কালো ছোপ-ছোপ অন্ধকার বটের মাথায় যেন গুচ্ছ-গুচ্ছ চুল। সন্ধ্যারাতের চাঁদের আলোয় গাছটকে বুড়ো দানব মনে হয়।
এই নির্জন অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তি হেঁটে আসছে। চলন্ত ছায়ামূর্তি নদীতীর ছেড়ে এবার দিঘির রাস্তা ধরে। বেশ খানিকটা পথ মাড়াতেই অদূরে নারকেল গাছটির মাথায় ঝুলে থাকা চাঁদ নজরে আসে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এবার হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে দেয়। ফুরফুরে হাওয়া ওঠে চারপাশে। গাছের পাতায় শিরশিরে আওয়াজ তোলে। চলন্ত মূর্তির লোমে ভরতি বুকেও বাতাসের পরশ লাগে, পরিপূর্ণ সুখের আবেশ অনুভব করে সে, রক্তের প্রতিটি বিন্দু তার আন্দোলিত হয়। চলন্ত মূর্তির নিশ্বাস দ্রুত হয়, বড়ো বড়ো পা ফেলে এক সময় পৌঁছে যায় জীর্ণ নারকেল গাছটির কাছে। পাশেই আমের আলীর এক চিলতে উঠান।
আমের আলী উঠানে ছায়ামূর্তির গলা খাঁকারি শোনে। তার বউ বনি দাওয়ার কোণে ছোট ছেলেটি নিয়ে বসেছে। ক্ষুধার জ্বালায় সারাদিন কেঁদেছে মাসু। সকাল থেকে পানি ছাড়া কারো গলায় তো কিছু ঢোকেনি। গতরাতে অবশ্য সাদা ভাত জুটেছিল। পাঁচ বছরের রাসুটা ক্ষুধায় ঘ্যান ঘ্যান করে এই মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
‘ও আপনে, আহেন ভাইসাব,’ আমের আলীর গলায় বাঁক, কণ্ঠে দরদ।
ঘরে আলো জ্বলেনি। আর আলোই বা লাগে কিসে ! খাওয়ার ঝামেলা নেই, অন্য কোনো কাজ নেই, শুধু পেটভরে পানি খেয়ে মরাঘুম দেয়া। খাওয়াই জোটে না তায় আবার কুপির তেল !
বনি দাওয়া থেকে উঠে ঘরে ঢোকে। চৌকিতে বিছানো জীর্ণ তালিমাড়া কাঁথার ওপর ঘুমন্ত ছেলের হালকা শরীরটাকে শুইয়ে দেয়। লিকলিকে দেহ। গায়ের হাড় সবই গোনা যায়। চৌকিতে বিছানো কাঁথাটি জরাজীর্ণ কিন্তু মলিন নয়। ছাপড়া ঘরের ভিতরে দারিদ্র্যের মলিনতা স্পষ্ট হলেও সবকিছুতে পরিপাট্য। এক ধরনের মিথ্যে খোয়াবি স্নিগ্ধ হাওয়া বিরাজ করে। ছেলেকে নামিয়ে রেখে উন্মুক্ত স্তনে শাড়ির আঁচল টানতে গিয়ে স্বামীর কথাটা বনির কানে আটকে যায়, ‘আপনের দয়ার দিল ; আপনেগো মতন মানুষ আছে বইলাই তো আমরা বাঁইচা আছি।’
‘তা মিয়া তোমার শইল কেমন অহন ?’ প্রশ্নটি কেবল উচ্চারিত হয়, কিন্তু জবাব পাবার আগেই আলাউদ্দিন নিজের নির্ভুল দূরদর্শিতা হাজির করে, ‘আমি তো আগেই কইছিলাম মিয়া, রিকসা চালান তোমার কাম না, মাজা ভাইঙ্গা অহন বোঝ !’
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আলাউদ্দিন একসময় কাশাকশি শুরু করে, গলা পরিষ্কার হলে সে ফিসফিস স্বরে বলে, ‘কী মিয়া, হইব তো !’
ফের নিস্তব্ধতা। অন্ধকার ফুড়ে একসময় ঠাণ্ডা স্বর বেজে ওঠে, ‘যান মিয়াভাই, ভিতরে যান, কোনো অসুবিধা নাই।’
‘না !’ সাথে সাথে ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ আসে ঘরের ভিতর থেকে।
পান-খাওয়া কালো দাঁত, মোটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ভস ভস করে বেরিয়ে আসা সিগারেটের কটু গন্ধ। বেঢপ দেহের কর্দয একটা মূর্তি বনির চোখে ভেসে ওঠে। অনেক দিন থেকেই এ ভূতছায়া তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সেদিন ঘাট থেকে ফেরার পথে বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে-থাকা বেঢপ-দেহ হাত টেনেছিল তার, কিন্তু পারেনি। সে আবার জোরাজুরিতে অবিশ্বাসী, এভাবে নাকি সুখ পাওয়া যায় না।
নিস্তব্ধতা। অদূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। চৌকিদার-বাড়ির বড়ো কাঁঠালগাছে হঠাৎ রাতের বেলা কাকেদের অস্বাভাকি ডাকাডাকি শুরু হয়। নির্জনতা ভেঙে দেয় কা কা শব্দ।
‘তাইলে অহনই আমার বারশো’ টাহা ফেরত দে। পানির সময় বিশ কেজি চাইল দিছি। আইজই সব ফিরত দিবি হালারপো, তোগো কত ত্যাল হইছে আইজকা সব বাইর করুম।’ লোকটা গজরায়।
আমের আলী ঘাবড়ে যায়। একটু পর গলায় জোর টেনে নিয়ে বলে ‘আপনে ভিতরে যান মিয়াসাব। মাইয়া মাইনষের কথা দিয়া তো আর দুন্নাই চলব না।’
আবার অপেক্ষা। একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ শোনা যায়। ভেতর ঘর থেকে আর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আলাউদ্দিন উঠে দাঁড়ায়, সাহসে ভর দিয়ে ইতস্তত পায়ে অন্ধকার মাড়িয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়। ঘরের ভিতর দৃষ্টিজাল ফেলে দেখে, জমাট বাঁধা কালোর মাঝে একজোড়া স্থির নিষ্পলক চোখ জ্বলজ্বল করছে। আলাউদ্দিন দোরের ঝাপিটা ঠেলে দেয়।
‘খবরদার লুইচ্চার বাচ্চা, আর এক পাও আইবি তো কল্লা ফালাইয়া দিমু !’ ক্ষিপ্র কণ্ঠের বজ্রাঘাত হতেই আলাউদ্দিন ভূতগ্রস্তের মতো ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রচণ্ড ঝড়ে কাঁপতে থাকা গাছের মতো বুক তার কেঁপে ওঠে। নিশ্বাস আটকে যায়। ভয় পেয়ে দুকদম পিছিয়ে এসে দরজার ঝাপিটা এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে সে। ফিনকি দিয়ে ঘরের ভিতর চাঁদের ফিকে আলো প্রবেশ করে। অস্পষ্ট আলোতে দুইহাতে উঁচু করে ধরা দাওটার দিকে তীক্ষè চোখে তাকিয়ে বনিকে ফণাতোলা গোখরোর চেয়েও ভয়ংকর মনে হয় তার। নিজের অজান্তে ঘাড়ে হাত বুলাতে গিয়ে আলাউদ্দির পুরো গা ছমছম করে ওঠে। নিঃশব্দে দাওয়ায় নেমে টুঁ-শব্দটি না করে একবারও পেছন না ফিরে হনহন করে উঠান পেরিয়ে যায় লোকটা।
বনি উদ্যত ফণা নিয়েই দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। একটা বিশ্রী গালি আমের আলীর জিহ্বার ডগায় এসে আটকে যায়। বউয়ের হাতে খাড়া দা’টার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শব্দ বের করতে পারে না। বনি দাও নামিয়ে রাখতেই আমের আলী দীর্ঘশ্বাস ঝরিয়ে বিড়বিড় করে, ‘কামডা তুই বালা করলি না।’
দূরের কোনো বটের পাতায় পাতায় অস্পষ্ট শব্দগুলো যেন ঝনঝন করে ওঠে। আমের আলী আর কিছু বলল না বটে, তবে এই একটি কথার অর্থ বুঝতে বনির বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না।
রাত বাড়ে। রাত গাঢ় হয়। আমের আলীর শঙ্কাগ্রস্ত কথাটা নির্জীব হয়ে পড়ে। চোখের পাতা ভারি হয় এবং একসময় তা বুজে আসে। কিন্তু সমস্ত চোখ বুজে গেলেও ছাপড়া ঘরের ভিতর শুধু একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ নিদ্রাহীন হয়ে ভোরের প্রতীক্ষা করে।
আবছা অন্ধকার এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সূর্যের লাল দ্যুতি চারদিকে। বনি তার সযত্নে রক্ষিত পলিথিন ব্যাগটিতে কাপড়সহ দু-একটি প্রয়োজনীয় জিনিস ভরে নেয়, তারপর ঘুমন্ত মাসুকে কোলে নিয়ে বড় ছেলের হাত ধরে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। আমের আলীর চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সে কেমন অস্থির বোধ করে, অবাক কণ্ঠে জানতে চায়, ‘তুই কই যাস ?’
‘ঢাহা।’ বনির সহজ জবাব।
‘ঢাহা গিয়া কী করবি ?’
বনি ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে ঘৃণার হাসি ফুটিয়ে তোলে, তার শুকনো মুখে সে হাসি মরা দেখালেও বড়ো দৃঢ় সেই ভঙ্গি, ‘শইলে যহন জোর আছে খাইটটা খামু, আকাম করমু না।’
উঠানের প্রান্তে জীর্ণ নারকেল গাছটির শাখাগুলো তখন হাওয়ায় পাখা মেলছে। বিয়ের পর স্বামীর ভিটায় এসে বনি নারকেলের চারাটি লাগিয়েছিল। উঠানে নেমে গাছটির দিকে বনি একবার তাকায়, তার মনে হল পাখির মতো ডানা দুলিয়ে গাছটা বুঝি এখুনি উড়ে যাবে। অথচ গাছটির শেকড় মাটি কামড়ে আছে শক্ত করে। স্তব্ধ হয়ে যায় বনি। স্বামী, এই বাড়ি, এই গ্রাম, দুটো সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এই চালা ঘরটার রক্তমাখা মাটি পেছনে ফেলে কোথায় যাবে সে ?
ভোরের বাতাসে বনির জীর্ণ শাড়ি পাখা হয়ে উড়ে যেতে চায়। অথচ তার পা দুটো নারকেল গাছটার শেকড়ের মতোই মাটি কামড়ে আছে। তখন বনির দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

জানুয়ারি ’০৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *