প্রবন্ধ, বাংলা

আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বারাক ওবামা

একটি টেলিফোন কল। নাইরোবি থেকে। বেরির তখন সকালের নাস্তা আধাআধি হয়েছে। রুমমেটের ডাকে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে তখন গড়গড় করে দ্রুত আওড়ে যাচ্ছে, হ্যাল বেরি বলছ? আমি তোমার আন্টি জেন। হ্যাল, শুনতে পাচ্ছ? শোন, তোমার বাবা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। বেরি…

নভেম্বরের এক শীতের সকালে আচমকা এই ফোন পেলেন আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যার পুরো নাম বারাক হুসেন ওবামা। সংক্ষেপে যাকে অনেকে বেরি ডাকত। যদিও বারাক তা পছন্দ করতেন না। শুধরে দিয়ে অনেককেই বলতেন, প্লিজ, কল মি বারাক।

ড্রিমস ফরম মাই ফাদার। বারাক ওবামার ৪৪২ পৃষ্ঠার বইটির শুরুর অধ্যায়েই এই ফোন কলের কথা। এর পরপরই লেখক আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার বাবার গল্পে। অবশ্য তার কাছে বাবা মানে ধোয়াশা একটা ব্যাপার। তার যখন মাত্র দুই বছর বয়স, সেই ১৯৬৩ সালে, বাবা তাদের হাওয়াইতে রেখে হারভার্ডে ডক্টরেট করতে চলে যান। এরপর বাবার মাথে ফের এবং শেষবার দেখা তখন বারাক দশবছরের বালক। মাত্র দুবারের দেখায় একটা মানুষের মনের মধ্যে বাবার চরিত্রটা কী রকম দাঁড়াতে পারে? মিথের কাল্পনিক চরিত্রের চেয়ে বেশি কিছু? বারাকও তার বাবাকে, যার নামও ছিল বারাক হুসেন ওবামা, এইভাবেই কল্পনা করেছেন।

বইটি পড়তে শুরু করলে ভোরের আকাশের ধীরে ফর্সা হওয়ার মতো একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠবে: এটি একটি শেকড় সন্ধানী লেখা। বারাক ওবামা কাল মানুষ। তার বাবা এসেছিলেন আফ্রিকার দেশ কেনিয়া থেকে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম কোন আফ্রিকান। আর মা অ্যান ডানহ্যাম, সাদা আমেরকিান, ক্যানসাসের বাসিন্দা। ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে দুজনের প্রেম, পরিচয়। অতঃপর বিয়ে। সেটা ১৯৬০ সাল। যদিও বর্ণবিবাহ ছিল তখন অবৈধ। পরের বছরই, মাত্র সতের বছরে অ্যান মা হলেন। আর বারাক হুসেন ওবামার পুত্র বারাক কালই হল।

কালদের ওপর নিপীড়ণ, বঞ্চনার শেষ নেই। এ নিয়ে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। বারাক ছোট্ট বয়সেই বুঝে গেলেন কাল সাদার বিভাজন। এবং সাদারা কালদের দেখতে পারে না, নিকৃষ্ট মনে করে। অথচ তার স্নেহময়ী মা সাদা। তবে সে এমন কাল কেন? তার বাবা কাল বলে?

যতই বয়স বাড়ে আমেরিকা নামক বিশাল দেশটিতে বারাক নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ভোগে। সাদাদের মাঝখানে তার মতো কালকে বড় বেমানান লাগে। নিঃসঙ্গতায় ভোগে সে। এছাড়া চলতে-ফিরতে, সবখানে কালদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তো আছেই। অথচ এই দেশ তার, এইখানে তার জন্ম।

বইয়ের শুরুতে, সেই টেলিফোনের পর বারাক তার মা, নানা, নানীর মুখে শোনা বাবার গল্প তুলে ধরে। আসলে বাবা সর্ম্পকে তার যতটুকু জানা তা এই গল্প শুনে শুনেই। দু দুবার বারাক কেনিয়া যান। এবং সে দুবার হচ্ছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কেন গেলেন তিনি কেনিয়া? এমন না যে বাবা ও বাবার পরিবারের সঙ্গে জোড়াতালি মারা কোনরকম যোগাযোগ টিকে ছিল। বরং উল্টোটা। তার বাবা পাঁচ-পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন। তার মধ্য দুজন সাদা আমেরিকান। অবশ্য কেনিয়ার সমাজ-ব্যবস্থায় এরকম পাঁচ-ছয়টি বিয়ে এবং গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেমেয়ে হওয়াও স্বাভাবিক। তবে? ওই যে বললাম শেকড়, মূল যে তার সেই কেনিয়ায় বাধা!

প্রথমবার কেনিয়ার মাটিতে নেমে তিনি যেন পৃথবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত হন। অনুভব করেন, এই তো তার আসল গোড়া। এইখানের মানুষগুলো সব তার মতো দেখতে। যেদিকে তাকাও কেবল কাল মানুষ। আমেরিকায় জন্ম হলেও এই প্রথম বারাক বিদেশের মাটিতে, তার পূর্ব পুরুষের দেশকে অন্তর দিয়ে ‘নিজের’ বলে বোধ করেন।

এই যে ‘নিজের বোধ’, আইডেনটিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয় সংকট, বর্তমান পৃথিবীতে এ সমস্যা কেবল একা বারাক ওবামার না। কাল, সাদা, বাদামি সব আদমিদেরই এই আত্মপরিচয়ের সংকট আছে। একটু ভাল খাওয়া, ভাল পরা, উন্নত জীবনের আশায় মানুষ ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এ নতুন নয়। ইতিহাসের শুরু থেকেই এ দেশান্তর চলছে এবং চলবে।

আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে এমনই এক বৃটিশ ডাক্তারের সঙ্গে বারাকের পরিচয় হয় কেনিয়ায়। ডাক্তার বলেন, আমার ছেলেবেলা কেটেছে কেনিয়ায়। বাবার এখানে চা বাগান ছিল। কেনিয়া স্বাধীন হলে এখানকার জমিজিরাত বিক্রি করে আমরা সপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে যাই। আমি ডাক্তারি পড়ি। পাশ করি। বিয়ে করি এক সাইক্রিয়াটিস্টকে। একসময় বউকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে চলে আসি আবার আফ্রিকায়। মালাউই-তে (আফ্রিকার আরেক দেশ) সরকারি বিভাগে পাঁচবছর ধরে ডাক্তারি করছি। বারাক তাকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, আপনি আফ্রিকায় ফিরে আসলেন কেন? রুমালে চশমার গ্লাস মুছতে মুছতে ভদ্রলোক উত্তর দিয়েছিলেন, আসলে ইংল্যান্ডে আমার নিজেকে বিদেশি লাগে। বরং এই আফ্রিকাকেই আমার নিজের দেশ মনে হয়, এখানকার লোকজন, প্রকৃতি যেন আমার নিজের। ইংল্যান্ডের লাইফ ভাল লাগে না।

এখন তো মিক্সড কালচার কথাটার খুব চল। আমাদের দেশের এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশই এই আবর্তে আটকে পড়া। এখানেও আছে আত্মপরিচয় সংকট। পাগলের মতো মানুষ অভিবাসী হচ্ছে। তাছাড়া ধনিক শ্রেণীরা তো ডাল-ভাতের মতোই ইউরোপ আমেরিকা যাওয়া আসা করেন। তাদের ছেলেমেয়েরা না পারছে বাংলা সংস্কৃতি গ্রহণ করতে, না পুরোপুরি ইংরেজি। এদের ভেতর একসময় ‘নিজের’ বোধটা যখন জাগ্রত হবে, তখন এরাও সেই আত্মপরিচয় সংকটে পড়বে। বারাক ওবামা ভাল মতই এ বিষয়টা তার বইয়ে তুলে ধরেছেন। তাছাড়া আমেরিকা দেশটাই তো অভিবাসীর দেশ। আত্মপরিচয়ের সংকট সেখানে একটি কমন সমস্যা। কেনিয়া গিয়ে বারাক তার বাবার এক বান্ধবী নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকার সঙ্গে পরিচিত হন। অধ্যাপিকা তার ছোট মেয়েটির কথা বলেন, যে সোয়াহিলি (কেনিয়ার একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা) ও ইংরেজি মিশানো ছাড়া কথা বলতে পারে না। আমাদের এখানে যেমন বাংলিশ। অধ্যাপিকার মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তিনি ঘন ঘন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া আসা করেন।

ড্রিমস ফরম মাই ফাদার বইটির তিনটি পার্ট বা অংশঃ অরিজিন, শিকাগো ও কেনিয়া। অরিজিন মানে উৎস, আর বারাকের উৎসটা কোথায়? সেই কেনিয়া। প্রথম ও শেষ দুটি অংশেই লেখক সেই উৎস বা আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন। মাঝের অংশ শিকাগো, যেই শহরে তার বেড়ে ওঠা, জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামী যৌবন। অরিজিন অংশের অনেকটা জুড়েই তার বছর পাঁচেক জাকার্তায় কাটানো সময়ের কথা আছে। তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান। তৃতীয় বিশ্বের নিদারুণ দারিদ্রের রূপটিও তিনি দেখেছেন সেখানে।

তিনটি অংশের মধ্যে কেনয়িার অংশটিই বেশি আকর্ষণীয়। লেখকের যেমন সেটা ভাল লাগার জায়গা, পাঠক হিসেবে আমরাও তার সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাস অনুভব করি। দু দুবার কেনিয়া গিয়ে বারাক তার পিতৃপুরুষের কাছের-দূরের প্রায় সমস্ত আত্বীয়-স্বজনের সাথে দেখা করেন। এমনকি পরের বার যখন যান সাথে নিয়ে যান তার বাগদত্তা বধূ মিশেলকে এবং বিয়েটাও সারেন সেখানে।

১৯৬৩ সালে বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া কেনিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পুরো একটি চিত্র পাওয়া যাবে এই বইটিতে। এসব যে বারাক জোর করে তার লেখায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন তা কিন্তু নয়, সবই এসেছে তার পূর্বপুরুষের মূলত তার পিতার জীবনকথা বয়ান করতে গিয়ে। আমাদের মতই একটি দরিদ্র দেশ কেনিয়া, দুর্নীতি যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার উপর রয়েছে ছোট বড় ৪০টি ভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যে বিবাধ। কেনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশটাই বিদেশীদের হাতে। সেই বৃটিশ ডাক্তারটির মুখ থেকে শোনা কেনিয়ার স্বাস্থ্যসেবার চিত্রটিও বারাক আমাদের জানিয়ে দেন। লোকজন প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, যেমন আমাশয়, চিকেন পক্স। আর সম্প্রতি বছরগুলোতে ভয়াবহ হয়ে দেখা দিয়েছে এইডস অবস্থাটা এমনই মহামারী আকার ধারণ করেছে যে কোন কোন গ্রামে এ হার পৌঁছেছে শতকরা পঞ্চাশ ভাগে। আর হ্যা, সেখানকার মানুষের খাবারদাবারও এই ভারতবর্ষের মতো, মসলা প্রধান।

বারাক ওবামার বইটি লেখার পেছনের বিষয়ে দু-চার কথা বলে শেষ করি। বারাক হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়াকালীন ‘হারভার্ড ল রিভিউ’-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এটি খুবই সম্মানজনক পদ। এটিই ছিল কোন কাল আমেরিকানের প্রথম ‘হারভার্ড ল রিভিউ’-র প্রেসিডেন্ট হওয়া। এক প্রকাশক বিষয়টাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। তিনি বারাককে একটি আত্মজীবনী লেখার অনুরোধ করেন। এজন্য বিরাট অংকের আগাম টাকাও দেন। ১৯৯৫-তে ড্রিমস ফরম মাই ফাদার প্রকাশিত হয়। ২০০৪-এ বইটি পরিণত হয় বেস্ট সেলারে। আর ১৯৯৬ সালে আফ্রিকান-আমেরিকান বারাক ওবামা ইলিনস রাজ্যের সেনেটর নির্বাচিত হন। তারপর বাকিটা আজ ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *