গল্প, বাংলা

একটি জোড়া লাগানো দশ টাকার নোট

নোটটি পেয়েছিলাম বেইলি রোডে। শাহবাগ থেকে তাড়াহুড়ো করে মহিলা সমিতিতে এসেছি ‘রক্তকরবী’ দেখব বলে। সেই তাড়াহুড়োতেই রিকশাঅলা আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো দশ টাকার নোটটি গছিয়ে দেয়। এসে তো ফাঁপরে পড়লাম। টিকেট নেই। কাউন্টারে অসহায় মুখে অনেকে দাঁড়িয়ে। অপর দৃশ্যে, অডিটরিয়ামে ঢোকার লাইন রাস্তা পর্যন্ত। ভীড়ের ঢেউ ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকছে। আমরা না-পাওয়ার দল অপেক্ষারত, টিকেট কি আদৌ পাব ? অনেকক্ষণ পর টিকেট ছাড়া হল। আর ছাড়ার সাথে সাথে না-পাওয়া দলের সবাই ধাক্কাধাক্কি শুরু করল : ব্রাদার আমাকে দুইটা, এই যে একটু তাকান না, আমাকে তিনটা, আমার…। ভেতরে ঢোকার যন্ত্রণাও কম নয়,  পুরুষদের গায়ে হাত দিয়ে চেক করা হচ্ছে আর মহিলাদের হাত-ব্যাগ খুলে। বোমাতংক !

দুই.

শীতের সকাল বড়ো মড়মড়ে, শুকনো পাতার মতো। নড়েচড়ে মড়মড় করে উঠতে উঠতে প্রায়ই নটার ক্লাস করতে পারি না। কিন্তু আজ ক্লাসটা ধরতেই হবে। ঝপাঝপ দুই বালতি পানিতে গোসল সারলাম। মনে হল এন্টার্কটিকা থেকে এইমাত্র উঠে এসেছি। প্লেটে ভাত দেখে উৎসাহ দমে গেল। উহ! সকালবেলা ভাত খাওয়া যায় ? কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করতেই মায়ের ঝাঁঝালো উত্তর শোনা যায়, তোর বাপ চৌদ্দটা দাসি-বান্দি রাখছে যে রুটি বানাইব ? ভয়াবহ সত্য কথা। অতএব সোনালি ধানের শুভ্র ভাত কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে তাড়াতাড়ি বাসস্ট্যান্ডে রিকশায় এলাম। ভাড়া দিতে গিয়ে সেই পুরনো সমস্যা, গতকাল থেকে যা বউয়ের মতো আমাকে আঁকড়ে আছে।
টাকাটা পালটাইয়া দ্যান।
কী হয়েছে এটা ? বলে যেন নতুন দেখছি ভাবে নোটটি প্রতিবারে মতো চোখের সামনে উল্টেপাল্টে পকেটে পুরলাম। মহা যন্ত্রণা ! কাউকে দুই টাকা বাট্টা দিয়ে নোটটি চেঞ্জ করা যায় না ?

তিন.

ক্লাস শেষে বরাবরের মতো রিংকি আজ আর আমাদের খাওয়া স্পন্সর করল না। ওর নাকি এখন খুব তাড়া। শেরাটনে সামনের সপ্তাহে জাঁকজমক করে ওর বাবা-মা’র বিয়ের ২৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান হবে। মন্ত্রী-আমলা-বিদেশী কূটনীতিকরা হবে চিফ গেস্ট। আমাদের বন্ধুদের সবাইকে দাওয়াত করবে কিনা কে জানে, দিলে তো এই সুযোগে পোড়াকপালে ফ্রি শেরাটন হোটেলে ঢোকার আর খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা জুটে যায়। প্রসারিত গলার স্লিভলেস শর্ট কামিজ পরা রিংকি সিঁড়িতে হাই-হিলের শব্দ তুলে নিচে নামে, আঙুলের ইশারা দিতেই প্রভুভক্ত কুত্তার মতো রিংকির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির হয়। তারপর ক্যাট করে দরজা খোলার শব্দ, ভিতরে ঢুকে চড়াম করে চড় মারার মতো দরজা লাগানো, এরপর পে-পু হর্ন দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে গাড়ি ছাড়া। রিংকিদের গাড়ি মোট তিনটা। দুইটা পাজেরো একটা সলিল। একেকদিন একেকটা নিয়ে আসে। দেখে পিত্তি জ্বলে যায়। দেশে এত হরতাল-অবরোধ-এক্সিডেন্ট হয় ওদের দু-একটা গাড়ির ওপর হামলা করলেই তো পারে। তবে মনে হয় না লাভ হবে। কয়েকদিন বাদে হয়ত নতুন মডেলের আরেকটা কিনে নিয়ে আসবে। চকচকে নতুন গাড়ি যা চোখের সামনে পড়লেই মনটা উদাস হয়। ইচ্ছে হয় জোরে বাম্পারে দুইটা লাথথি লাগাই।

চার.

দুপুরের পরের সময়টা বড়ো বাজে। কাজ-কাম নাই শুধু বেলা পুড়িয়ে সময়ের ধোঁয়া ওড়াও। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে তাই নিুমধ্যবিত্ত জীবনের ফেলে আসা ধারাপাত নিয়ে বসি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় একদিন এক ছেলে দেড় গজ দূরের বেঞ্চ থেকে আমার বেঞ্চে হনুমানের লঙ্কা পার হওয়া লাফ দিয়ে গর্বে এক পা উঁচিয়ে বলেছিল, নতুন কিনছি, বহুত দামি জুতা ; একটা লাথথি দেই ? দামি জুতার লাথথিও দামি, দেই ? আমি নিষ্পাপ বাছুরের চোখ নিয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে ছিলাম ছেলেটির দিকে। ঈদের সময় আব্বাকে ঐ জুতা কিনে দেয়ার আবদার করলে দাম শুনেই চোখ কপালে তুললেন, য়্যাতো দামি জুতা, য়্যাতো টাকা কই পামু ! তোর মায়রে দুই ঈদে একটা শাড়ি দিতে পারি নাই, তোগো পরীক্ষা আইসা পড়ছে আধসের দুধ রোজ করন দরকার, হেইডাও পারতাছি না। দামি জুতা পরলেই কি দামি মানুষ হয় ! পড়াশুনা ভালো মতো কর, চাকরি-বাকরি কইরা নিজেরাই একসময় কত দামি জুতা কিনতে পারবি।
এরপর জীবন অনেক বর্ষা-শীত-বসন্ত খেলো। জীবনের দোলনাও দুলতে থাকে ধীরে ধীরে, টুপ টুপ পড়া বৃষ্টির ফোঁটায় দোল খাওয়া গাছের পাতার মতো। প্রথম অভিসারে বিন্দুকে নিয়ে বলধা গার্ডেন যাচ্ছিলাম। পথে ঠাঁটারি বাজারের নাড়ি-ভুড়ির গন্ধ ওকে অসুস্থ করে তুলল। রাগে ও আমায় রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চেয়েছিল, কোন আবর্জনায় নিয়ে চলেছ আমাকে ? এই তোমার রুচি ? পরদিন হলের ফোনবক্সে একটা আধুলি ফেলে জেনেছিলাম, পুরান ঢাকার রাস্তায় রিকশা চড়ে বিন্দুর কোমরে ব্যথা ধরে গেছে। আসলে আমারই ভুল ছিল, ওর টয়োটা করোলার নরম গদিতে চড়া পাছা, নারিকেলের কর্কশ ছোবরার রিকশার সিটে বসে ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারবে কেন? বিন্দুর গাড়িতে যেদিন আমায় প্রথম লিফট দিল সেদিন আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। পরস্পর বিদায়ের উষ্ণ হাসি বিনিময় করে নামতে উদ্যত হতেই বুঝতে পারলাম, আমার অনভ্যস্ত হাত দরজা খুলতে পারছে না। তখন ঢাকার রাস্তায় ট্যাক্সি নামেনি, এর আগে বেশ কয়েকবার কার-মাইক্রো চড়েছি, কিন্তু আজ এমন কেন হল ? হয়ত অনেকদিন না-চড়াতে হঠাৎ ভুলে গিয়েছিলাম। বিন্দু আমার দিকে ঝুঁকে একটা করুণার দৃষ্টি ছুড়ে দরজা খুলে দিল। গাড়ি থেকে মাথা নিচু করে নামলাম। নিজেকে মনে হল ডাস্টবিনে প্রচণ্ড আক্রোশে নিক্ষেপিত কোনো আবর্জনা ; মুহূর্তে রাস্তার কিনার থেকে সোজা মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। দুই সেকেন্ডের মধ্যেই একটা জিপ এসে ঠিক আমার সামনে ক্যাচ করে ব্রেক কষলো। আমি তখন আকাশে কাশফুল দেখছিলাম। হয়ত পাগল-টাগল ভেবেছিল, জিপটি পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
একটা চকলেট খান। আমি স্বপ্নালু চোখে সামনে তাকাই। চার-পাঁচ বছরের একটি ছেলে। ডানহাতে একটি চকলেট বাড়িয়ে বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল মুখে চুষছে। ধূলোভরা শরীর, লালচে চুল, নাক বেয়ে সিকনি পড়ছে, খালি পা আর হাফপ্যান্টের জিপার নিশ্চয়ই নষ্ট। নুনু দেখা যাচ্ছে। আমি ছেলেটাকে না করতে পারি না, পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে চকলেটটি নেই।
দুই-টাকা দাম, দুই-টাকা। ভেঙে ভেঙে আস্তে আস্তে বলে শিশুটি।
আরে ওটা তো পাঁচ টাকা দিছি, এক টাকা না, তোর টাকা ফেরত লাগব না, সব নিয়ে যা।
না দুই-টাকা দ্যান, দুই-টাকা।
কী মুসবিতে পড়লাম, এ ছেলে তো টাকাই চেনে না, চকলেট বিক্রি করে কীভাবে। একটু দূর থেকে একটি মেয়ে বোধহয় বড়বোন হবে ডাক দিলে ছেলেটি দৌড় দেয়। ছেলেটির হিসাবমতো আমি যদি ওকে এক টাকা কম দিয়েই থাকি ওর দৌড় দেখে মনে হল ওটা ওর কাছে কোনো বিষয়ই না। বুক থেকে একটা ভারি নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুমানোর অবশ্য সুযোগ নেই, সন্ধ্যায় টিউশনি সেরে একবারে বাসায়। কী করা যায় এখন ? বিন্দুর বাসায় গেলে কেমন হয় ? সম্পর্ক সমাপ্তির পর বহুদিন যাইনি। যাব ? কিন্তু গেলে যদি অপমান করে !

পাঁচ.

কলিংবেল চাপতেই বিন্দুর বাবা দরজা খুললেন। লম্বা-চওড়া একজন মানুষ, ‘কাকে চাই’ শুনে চোখ দুটো তার অসন্ধিৎসু হয়ে উঠে। এক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে তারপর মুখ পেছনে ঘোরান, বিন্দু তোমার গেস্ট।
ভালো আছ ? বিন্দুর হাসিমুখ, এসো। বিন্দুর সাথে ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। এই ঘরটা চেনা বাগানের মতো। আমি যে দিকটায় বসি ঠিক উল্টোদিকে বিন্দুর দাদার যৌবনকালের একখানা বাঁধানো ফোটো। বামদিকে দেয়ালের অর্ধেক জুড়ে টাঙানো হয়েছে কাবাশরীফের ছবি। ডানদিকের দেয়ালে দেয়ালঘড়ি। টি-টেবিলে নীল রঙের অ্যাশট্রে, টিভির রিমোট তুলে দেখলাম প্লাস্টিক কাভারে এখনো সেই ছেঁড়াটা আছে। তবে আগে এ বাসায় আসলে বুক দুরু দুরু যে ভাবটা ছিল এখন আর তেমন বোধ হচ্ছে না।
তারপর বল। বিন্দু পায়ের উপর পা তুলে বসল।
এই তো চলছে। আমার সংক্ষিপ্ত জবাব।
তুমি নাকি আমার নামে বদনাম ছড়াচ্ছ ?
বদনাম ! বিস্ময়ের ভাব করে কথার মারপ্যাচে কোনোরকমে আমি প্রশ্নটা এড়িয়ে যাই।
মিষ্টি বিস্কিট আর কোক দিয়ে আপ্যায়ন হল। বিদায় নেবার বেলায় আজ কেমন অন্য হাওয়া বইল। সবসময় ‘যেতে চায় না মন’ একটা ভাব থাকে। কিন্তু আজ সাপের মতো ছোবল দিয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
ইচ্ছে হলে আসতে পার। বিন্দুর বিদায় প্রস্তাব।
ভালোবাসার উত্তাল দিনগুলিতে আগে প্রতিবার যাওয়ার সময় বলত, এসো মাঝে মাঝে বাসায় কিছু মনে করবে না, তবে সপ্তাহে একবারের বেশি না। পরিচিত ঘরটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে সিঁড়িতে পা দিলাম, জানিনা আর কখনো আসব কিনা।
মোড়ের দোকানে এসে সিগারেট কিনলাম। বুকপকেটে হাত দিতে দশ টাকার নোটটি বেরুলো। দোকানদারও এক পলক দেখে ড্রয়ারে ঢুকায়। যাক হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সিগারেট ধরাতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। একি জোড়া লাগানো নোটটি দেয়ার অপরাধবোধের জন্য, নাকি বিন্দুর সাথে সাক্ষাৎ-উত্তেজনায় ? ‘আরে ভাই সিগারেট তো উল্টা ধরাইছেন !’ কী ! আমি আঙুলের দিকে তাকাই, সত্যিই তো। ইলিয়াসের গল্পের আব্বাস পাগলার কথা মনে পড়ল। উল্টোভাবে ঠোঁটে বসিয়ে ব্যান্ডেজঅলা সিগারেট খায় না বলে সে সিগারেট ছুড়ে ফেলে দেয়। মুখ ভরতি ধোঁয়া ছেড়ে ভালো লাগছে হাঁটতে। হালকা লাগছে। বুকপকেট থেকে জোড়া লাগানো টাকাটাও গেছে ! রিকশা নিয়ে টিউশনিতে এলাম। আমোদের সাথে মানিব্যাগ থেকে শেষ দশ টাকার নোটটি বের করি। কিন্তু রিকশাঅলাকে দিতেই চরম বিরক্ত হল, টাকাটা পাল্টাইয়া দ্যান।


অগাস্ট ২০০৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *