গল্প, বাংলা

তাহার কথা

‘ব্যাপারটা কি?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন।
‘মানে…’ মেয়েটি ঘাড় গুঁজে এক নখ দিয়ে আরেক নখ খোঁচায়, ‘হাজব্যান্ডের সাথে আমার কখনো ওইসব হয়নি।’
ডাক্তার স্থির চোখে মেয়েটির দিকে তাকান, কিছু পড়ার চেষ্টা করেন, ‘তোমরা কি একসাথে ঘুমাতে?’
‘হুম’। মেয়েটি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে।
‘সে কি সমকামী?’
‘আমি জানি না।’
মেয়েটি আবার নখ খোঁচায়। বেশ মলিন মুখখানি। বয়স উনিশ-বিশ। বেঁটেখাটো। ঘাড় নেই বললেই চলে। পরনে জিন্স আর কামিজ। নাম কুসুম। গত আট-নয় মাস ধরে সে মানসিকভাবে স্বাভাবিক নেই। জামাই সিলেটী-বাংলাদেশী। পারিবারিকভাবে দেশ থেকে বিয়ে করে এনেছিল। চলে যাচ্ছিল একরকম। ঝামেলার শুরু বিয়ের মাস ছয়েক পর; কুসুম যখন স্বামীর কাছে প্রতিনিয়তই ব্যাপারটা নিয়ে কথা উঠায়। একদিন এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হলে শ্বশুর-শাশুড়ি শুনে ফেলে। তারা মেয়ের বাপ-মা’কে ফোন দেয়—এ মেয়ে ভাল না, তারা রাখবে না। লন্ডনে মেয়ের যে দূর সম্পর্কের চাচা আছে সে যাতে এসে মেয়েকে নিয়ে যায়।
কুসুমকে তাই করতে হয়। চাচার বাসায় আপাতত ওঠে বটে। কিন্তু লন্ডনে কেইবা বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে? দেশে ফিরে যাওয়াও চরম লজ্জার, অপমানের। মানসিকভাবে ভয়ানক ভেঙ্গে পড়ে কুসুম। আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। পরবর্তীতে তার স্থান হয় মুসলিম এইড সেন্টারের কেয়ারে।
লি ইউনিটের একটি রুমে তিনজন বসে আছি। ডাক্তার কুসুমকে প্রশ্ন করেন। বাংলায় তা কুসুমকে বুঝিয়ে বলি। কুসুম উত্তর দেয়। সেটি আবার ইংরেজিতে ডাক্তারকে জানাই। এই আমার কাজ—ইন্টারপ্রেটিং। মাঝে মাঝেই সেন্ট অ্যান হসপিটালে অ্যাসাইনমেন্ট পড়ে। এই হসপিটালে লন্ডনের মেন্টাল হেলথ কেয়ারের বড় বিভাগ রয়েছে।
কথার ফাকে ফাকে ডাক্তার কাগজে নোট নেন। কুসুমের হাজব্যান্ডের বিষয়ে ডাক্তার কি বুঝলেন কে জানে। ওই প্রসঙ্গের পর জিজ্ঞেস করেন, ‘কুসুম, আমি জেনেছি মুসলিম এইড সেন্টার ছেড়ে আসার পর তোমার মন আরও খারাপ।’
‘হ্যাঁ।’ কুসুম চোখ তোলে, ‘ওখানে আরও বাঙালি মেয়ে ছিল, কথা বলতে পারতাম। এখন যে হোস্টেলে থাকি এখানে বাঙালি কেউ নাই। খুব একলা লাগে।’
মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর মুসলিম এইড সেন্টার থেকে সরকারিভাবে কুসুমকে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ভিসার কিছু জটিলতা ছিল, সেসবও মুসলিম এইড সেন্টার আইনজীবী দিয়ে সমাধান করে দেয়।
‘এক্ষেত্রে কি করা যায়?’ ডাক্তার বলেন, ‘মুসলিম এইড সেন্টার তো স্থায়ী কোন ব্যবস্থা না, ইমারজেন্সি অবস্থায় তোমাকে সেখানে রাখা হয়েছিল। তুমি কি দেশ থেকে ঘুরে আসতে চাও?’
‘না’ কুসুমের দ্রুত জবাব। ‘দেশে গেলে আমি মুখ দেখাব কিভাবে; আমার পরিবারও সবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। আমার ছোটবোনের বিয়ে হবে না। দেশে আমি যেতে চাইনা।’
‘সেক্ষেত্রে, বাঙালি নারীদের জন্য কিছু রিক্রিয়েশন সেন্টার আছে, যেখানে মাঝে মাঝে গেলে অনেকের সাথে পরিচয় হবে, কথা হবে। যাবে এমন এক জায়গায়?’
‘জানি না। ইচ্ছা করে না।’
ডাক্তার ছোট্ট করে শ্বাস ফেলেন, ‘আচ্ছা, তোমার এখন কি কি সমস্যা হয় বলতো।’
‘কোন কিছুই ভাল লাগে না’, কুসুম থেমে থেমে বলে, ‘মনে জোর পাই না, সবকিছু ভুলে যাই। রাস্তায় হাঁটার সময় হঠাৎ হঠাৎ মাঝখানে চলে যাই; টের পাই না। রাতে ঘুম হয় না।’
এই হোস্টেলে ওঠার পর কুসুম হাত কেটে আরেকবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালায়। ডাক্তার কুসুমকে তাই একটা ইমারজেন্সি নাম্বার দেন, যেটা ২৪ ঘণ্টা খোলা। যখনি খুব খারাপ লাগবে সেখানে ফোন দিতে পারবে। সপ্তাহের প্রতি সোমবার এখানে এসে ডাক্তার দেখানো আর আগের দেয়া ওষুধগুলো চালিয়ে যেতে বলে আজকের সেশন শেষ হয়। হসপিটাল থেকে রাস্তা চিনে হোস্টেলে যেতে পারবে না বলে ডাক্তার কুসুমকে একটি ট্যাক্সিরও ব্যবস্থা করে দেন।
আমি বাড়ির পথ ধরি। সেন্ট অ্যান হসপিটালটা এমন এক জায়গায় যেখানে হাঁটা ছাড়া উপায় নাই। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। হাতে ছাতা আছে, কিন্তু খুলতে ইচ্ছা করছে না। চিন্তায় প্রচ্ছন্নভাবে এখনো কুসুমের বিষণ্ণ মুখ। মেয়েটা! না আছে কোন বন্ধুবান্ধব, কথা বলার মানুষ, না পারে ইংরেজি। এসময় একটা সঙ্গি খুব দরকার। এক্কেবারে একা একটা মানুষ বাঁচে কিভাবে? দেশ থেকে কুসুমের মতো স্বল্পশিক্ষিত মেয়েকে ছেলেবউ করে লন্ডনে আনার কারণটা সহজেই বোধগম্য। এরা সাত চড়ে রা করবে না, যা বলা হবে তাই করবে, নিজের অধিকার বিষয়ে কোন ধারণা নাই, ইংরেজি না জানায় ঘরের চার দেয়ালেই সে বন্দী, এবং আরও সুবিধা বেকার দেখিয়ে তার নামে সরকারি বেনেফিট তোলা যাবে।
অদ্ভুত বিষয় হল, এই পর্যন্ত যত মানসিক রোগীর ইন্টারপ্রেটিঙে গেছি, একজন ছাড়া বাকি সবাই নারী। এবং সবার সমস্যার ধরনও প্রায় একরকম। স্বামীর সংসারে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত; দেশ থেকে আসা এবং নিঃসঙ্গ। ডাক্তার তাদের যেসব প্রশ্ন করেন সেসবও আমার প্রায় জানা— আপনি কি (অলৌকিক) কোন শব্দ বা কথাবার্তা শোনেন? আপনার কি মনে হয় অন্যরা আপনার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে? আপনার মরে যেতে ইচ্ছা হয়? রাতে ঘুম হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাসায় এসে দেখলাম মইনভাই তখনো বের হয়নি। সে কয়েকমাস হল স্টুডেন্ট ভিসায় ইংল্যান্ডে এসেছে। পার্মানেন্ট কোন কাজ এখনো জোটাতে পারেনি। বিষণ্ণতায় ভোগে। মজা করে বললাম, ‘মইনভাই, একটি মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। ভিসা স্ট্যাটাস ‘ইন্ডেফিনেট লিভ’।বিয়ে করবেন নাকি? তাহলে আপনারও সমস্যা আসান, মেয়েটিও বেঁচে যায়। ভেবে দেখেন, বিয়ে করলে ব্রিটিশ পাসপোর্ট। রাতদিন কাজ করবেন, খালি টাকা আর টাকা।’
আমি খুলে বলি। মইনভাই বলে, ‘মেয়ের নাম্বার দেন।’
‘নাম্বার তো জানি না। নরদাম্বারল্যান্ডের কাউন্সিল হোস্টেলে থাকে। ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, মেয়ে বের হলে কথা বলবেন। তারপর প্রেম শুরু।’
‘ধুর মিয়া’। মইনভাই বেরিয়ে যায়।
এরপর মাস দুই পেরিয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়াতে ‘ব্লু ক্রস’ এনিম্যাল হসপিটালে নাইট কিউরেটরের কাজ করি কখনো কখনো। রাত ৮টা টু সকাল ৮টা। কাজ শেষে বের হয়ে সকালের ঠাণ্ডা বাতাসটা চমৎকার লাগে। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর এ বাতাস যেন সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে। টিউবে উঠে গা এলিয়ে দিয়ে পাশে পড়ে থাকা ফ্রি ‘মেট্রো’ পত্রিকাটা তুলে নেই। খবরের বড় অভাব এদেশে। প্রথম পাতার হেডলাইন করেছে এক সেলিব্রেটির বয়ফ্রেন্ড নিয়ে। অলসভাবে পাতা উল্টে যাচ্ছি। একটা ছোট্ট খবরে চোখ আটকে যায়—‘ভ্যান কিলস ইন্ডিয়ান গার্ল’। খবরটায় লিখেছে, গতকাল সন্ধ্যায় আঠার-উনিশ বছরের একটি ইন্ডিয়ান মেয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে নরদাম্বারল্যান্ড অ্যাভেন্যুতে ভ্যানের ধাক্কায় মারা গেছে। ভ্যান চালক জানিয়েছে, মেয়েটি হুট করে তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে, তার কোন দোষ ছিল না। পুলিস মেয়েটির সাথে কোন পরিচয়পত্র খুঁজে পায়নি। তবে দুর্ঘটনাস্থলের সামনের এক চিকেন-চিপসের দোকানি বলেছে, মেয়েটিকে সে আগে দেখেছে, তবে কোথায় থাকে জানে না। তার ধারণা মেয়েটি ইন্ডিয়ান বা বাংলাদেশী হবে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। চোখের সামনে একটি ছোট্ট বিষণ্ণ মুখ দুলতে থাকে। আমি জোর দিয়ে বলি, ‘এ নিশ্চয়ই সে নয়!’

আশ্বিন ১৪১৯

One thought on “তাহার কথা”

  1. Hi, this is a comment.
    To get started with moderating, editing, and deleting comments, please visit the Comments screen in the dashboard.
    Commenter avatars come from Gravatar.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *