গল্প, বাংলা

লাল ফ্রক

ঘুমের ওষুধ আজকাল আর খাই না। শুধু শুধু। ওতে আমার কিছু হয় না। ঘুম বলতে কোন কোন রাতে চোখটা হয়ত একটু লেগে আসে, পরক্ষণেই নাইটগার্ডের তীব্র হুইসেলে চোখ খুলে যায়—এইটুকুই।

আজ অনেকক্ষণ হল নাইটগার্ডের সারাশব্দ নেই। বিহারী বুড়ো লোকটার অসুখবিসুখ করল কিনা কে জানে। আমার রাতের একমাত্র সঙ্গী বলে কথা। নোনা জলে ভেজা বালিশে মুখ ঘুরিয়ে শুই। আজ সারাটা দিনই অস্থিরতায় কেটেছে। ডান চক্ষু লাফিয়েছে। অহেতুকই ঘরের আলমারিটা লাগিয়েছি আর খুলেছি। কী যেন একটা মনে হয়েছে নেই, সেটা খোঁজা দরকার। কিন্তু সেটা যে কী, তাই জানি না। অনেক সময় হয় না এরকম? হয়তো খুব তুচ্ছ জিনিসই সেটা।

ঘুম মানুষের না আসে কিভাবে, এটা একসময় আমার মাথাতেই ঢুকত না। বালিশে মাথা দিলেই ঘুম। অথচ এই বালিশে মাথা দিয়ে, ভালবাসার মানুষটার পাশে শুয়ে, প্রথম আমার না-ঘুমের শিক্ষা। ইনসমনিয়া! বিয়ের তৃতীয়দিন থেকেই। আর আমার পাশের বালিশেই, আমার প্রিয়তম মানুষটি, যার সঙ্গে পুরো জীবন কাটাব বলে পণ করেছিলাম, তখন নাক ডেকে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মিলনের পরিশ্রমও তো কম নয়!

সেজভাইর কথাটা এখনও কানে বাজে। ইমরানদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে এসে বলেছিল, ওদের ফ্যামিলিটা আমার কাছে ভাল লাগেনি। মা-টা জানি কেমন। জানিস তো মা ভাল তো সব ভাল। আমি ওখানে তোর বিয়ে সাপোর্ট করি না, তারপরও যদি করিস, সেটা তোর রেসপনসিবিলিটি।

পরিবারের সবাইও একরকম আপত্তি জানাল। কিন্তু আমি একবার যে সিদ্ধান্ত নেই সেটা করেই ছাড়ি। দেড়বছরের প্রেম। অতএব বিয়েটা করলাম। এবং বিয়ের তৃতীয়দিনই টের পেলাম—ভালবাসার মানুষটির ভালবাসার রূপ।

কলেজে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা ছিল। প্রায় সারারাত লাইট জ্বালিয়ে পড়েছি। ইমরান তাই ভালমত ঘুমাতে পারেনি। দুপুরে পরীক্ষা। সকালে উঠেও অনেকক্ষণ পড়লাম। বিয়ের পর আমরা মহাখালিতে একটা সাবলেটে উঠি, ওর এক কাজিনের সাথে শেয়ার করে। মহাখালি থেকে গার্হস্থ্য কলেজে কীভাবে কোন বাসে যেতে হয়, জানি না।
আমাকে আজকে একটু কলেজে দিয়ে আসবে? রাস্তা চিনি না তো।
উত্তরে ওর চোখে তখন রাগ, কণ্ঠে বিরক্তি। বলল, বালের পরীক্ষা দিতে যাবা, যাও, আমি যাব কেন? আমি হা হয়ে যাই। আমার চোখের মণি দ্রুত নড়তে থাকে। কানকে বিশ্বাস করাতে পারি না। এমন কিছু শুনেই কি সতী সীতা বলেছিল, ধরণী দ্বিধা হও? আমি জানি না।

ওর কাজিনের বউ, মানে লিনাভাবি এসে ওকে ধমক দিলেন, কী ইমরান, এ কেমন কথা, বউয়ের দায়িত্ব নিতে পারবে না তো বিয়ে করেছ কেন? মেয়েটা মহাখালি থেকেছে কখনো? সাথে যেতে না পার, একটু বাসে উঠিয়ে দিয়ে আস।

ইমরান গজগজ করতে করতে শার্ট গায়ে চড়ায়। সিঁড়িতে নেমে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা আমাকে একটি চড় বসিয়ে দেয়। মুহূর্তে আমার পৃথিবীটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। গালে হাত দিয়ে আমি হতবাক-চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কে অই মানুষটা? তাকে কি আমি চিনি? আমার রাগি বাবাও আমার গায়ে কখনো হাত তুলেছে বলে মনে পড়ল না। অথচ আমার প্রিয়তম মানুষটি…। ইমরান নেমে যাচ্ছে আর আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে আবার গজরায়, দাঁড়িয়ে আছিস কেন, পরীক্ষা দিতে যাবি না? আয়।

এক-দুইটা দিনের ফারাকে মানুষ এত বদলে যেতে পারে! মানুষ চেনা তবে এতটাই দায়? পরীক্ষায় কি লিখেছিলাম মনে নেই। তবে পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে সিদ্ধান্ত নিলাম, চলে যাব। লিনা ভাবি তখন বোঝালেন, দেখো, ছেলেরা একটু অমনই হয়। সংসার করতে গেলে মেয়েদের অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়। ওর এরকম আচরণ তো তুমি আর কখনো দেখোনি, তাই না? সারা রাত না ঘুমিয়ে ইমরানের মেজাজ হয়তো ঠিক ছিল না, বুঝতে পারেনি।

ভাবির কথা মেনে নিলাম। ছেলেরা একটু অমন হয়-ই। তাছাড়া বিয়ের দুদিন যেতে না যেতে কোন মুখে আমি বাড়ি ফিরে যাব? আবার ছোটপা, মানে হাসি আপাও একটা বড় ফ্যাক্টর। পরপর দু-দুটা বোনের যদি একই অবস্থা হয়, লোকে বলবে কী? আমরা কুফা, স্বামীর ঘর করতে পারি না!

অথচ ছোটপার অ্যারেঞ্জড বিয়ে ছিল। ছেলে এবং ছেলের পরিবার দুই বেশ ভাল। ছেলে তার বড়ভাইর সঙ্গে থাকত। দেবর-ভাবির একবারে গলায় গলায় পিরিত। হবে না? তার শ্বাশুড়ি ছোট ছেলেকে দশ বছরের রেখে মারা যায়। মায়ের আদরটা তো তেমন পায়নি। ভাবি-ই সব। সন্দেহ হলেও প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও ছোটপা বিষয়টাকে তেমন আমল দিত না। কিন্তু একদিন সন্দেহটা সত্যি হয়ে যায়।

বিয়ের কয়েক মাস পরের ঘটনা সেটা। ছোটপার গোসলে বেশ সময় লাগে। টয়লেট ও গোসল দুই সে একসাথে সারে। সেদিন টয়লেট সেরে নতুন কেনা শ্যাম্পুটা নিতে মাঝখানে বেরিয়েছে। আবার বাথরুমে ঢোকার আগে ড্রইংরুমে একবার উঁকি দেয়। স্বামীধনটি সেখানে পত্রিকা পড়ছিল। নেই। ভাবির ঘরের দরজা বন্ধ। কোথায় তাহলে? বুকে ধিড়িম ধিড়িম দুরমুশ পড়তে শুরু করে ওর। ছোটপা ছুটে গিয়ে ভাবির বন্ধ দরজায় কান পাতে। ভেতরে কথার ফিসফিসানি। পাগলের মতো সে মেঝেতে শুয়ে পড়ে দরজার ফাঁকে কান রাখে। শীৎকারের শব্দ!

ছোটপা সেদিনই বাড়িতে চলে আসে। এবং পরিবারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক একসময় ডিভোর্স দেয়।

এই যদি করবি তাহলে কেন বিয়ে করেছিস? কেন আরেকজনের জীবনটাকে নষ্ট করলি? ছোটপা সে বদমাশটাকে এ প্রশ্ন করেছিল।

সেই জন্যেই তো বিয়েটা করা, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। সাথে লোকটা এও জানিয়ে দিয়েছিল, বউকে সে ছাড়তে পারবে কিন্তু ভাবি ছাড়া তার চলবে না।

এসব কিছু বিবেচনা করে সেদিন ইচ্ছে সত্ত্বেও আমি চলে আসতে পারিনি। তাও বেশিদিন সম্ভব হল কই? দেড়বছর। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু না, ও ঠিক হবার নয়। গায়ে হাত তোলা ওর খাসলত। এতে ইমরানের ফ্যামিলির প্রভাবও আছে। সেজভাই ঠিকই বলেছিল। ইমরানদের পরিবারটা কেমন যেন। বিয়ের কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারলাম শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যে সম্পর্ক ভাল না। ইমরান যখন ছোট তখন থেকেই তারা নাকি আলাদা ঘরে ঘুমান।

ঈদের সময় খুলনায় ওদের বাড়িতে যেতাম। ওর মায়ের একটা অদ্ভুত আচরণে খুবই অবাক হয়েছিলাম। রাত্রে আমরা দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে পারব না। ওনার আদেশ। এটাকেই ইডিপাস কমপ্লেক্স বলে কিনা জানি না।

ইমরানও ছিল, একেবারে ফ্যামিলি প্রাণ। মা-বোনরা যা বলত তাই বিশ্বাস করত। বিয়েটা ইমরানের দিক থেকেও যেহেতু ছিল নিজের পছন্দের এজন্য ওর পরিবার আমাকে সহজভাবে নিতে পারেনি। তাদের ধারণা, তাদের ছেলে আরো বড় ঘরে, আরো ভাল মেয়ে পেত, আমি ডাইনি মাগিই ওর মাথাটা খেয়েছি। আমার বিরুদ্ধে সবসময় ওকে বিষিয়ে তুলতে তাই তারা চেষ্টায় খুঁত রাখেনি।

আজ এখন আমি আর কোন পুরুষকেই বিশ্বাস করি না। করতে পারি না। সব পুরুষই এক। বিয়ের পর ধীরে ধীরে টের পেয়েছিলাম, ইমরান কার সঙ্গে যেন গোপনে কথা বলে। হয়ত আমার অগোচরে দেখাও করত। সংখ্যাটা একাধিক হওয়া আশ্চর্য নয়। প্রমাণ ছাড়া আমার কোন কিছুতে বিশ্বাস নেই। রাতে ইমরান যখন ঘরে তখন বাথরুমে গিয়ে আমার মোবাইলের সিম চেঞ্জ করে ওর সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। অদ্ভুত ব্যাপার হল, আমার গলা তো ও ধরতেই পারেনি বরং কয়েকদিনের মধ্যেই আমাকে প্রেম নিবেদন করে বাইরে দেখা করার জন্য ভজাতে থাকে।

ওর ল্যাপটপ ছিল। অনেক রাত অব্দি তাতে কাজ করত। ও বাথরুমে গেলে আমি ওটায় গুতোগুতি করতে গিয়ে দেখতাম, মেয়েদের সাথে চ্যাট করছে। আর কথার কী ছিরি। সেক্স নিয়ে তো আছেই। এসব দেখে আমার বুকটায় আগুন ধরে যেত। আচ্ছা, পুরুষ মানেই কি বহুগামী? অথচ সেপারেশনের এতদিন পরেও আমি তো পারলাম না মনের মধ্যে অন্য কাউকে স্থান দিতে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, ইস, ইমরানকে নিয়ে যদি দূরে কোথাও, দেশের বাইরে চলে যেতে পারতাম! যেখানে ওর পরিবার-আত্মীয়-লোকজন—অন্যান্য সবকিছুর হাত থেকে বাঁচা যাবে। ওর যে সবই খারাপ তা তো না, কিছু ভাল গুণও আছে। আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাথা ব্যথায় দুনিয়াটা যন্ত্রণাকর হয়ে উঠলে, ও আমার মাথা টিপে দিত। অসুস্থ হলে সেবা করত। তখন সকালে নাস্তা না বানাতে পারলে কিছু বলত না। দুজনে বাইরে কোথাও বের হলে রাস্তায় লোকজন যদি আমার দিকে অশ্লীলভাবে তাকাত, ও খেকিয়ে উঠত, পারে তো মারামারি লাগিয়ে দিত। আমাদের কত সুখের স্মৃতি আছে। ছুটির দিনে সন্ধ্যায় দুজনে খেতে বের হতাম। আমাদের পছন্দ ছিল কেএফসির চিকেন ফ্রাই আর কফি।

তবে লিনাভাবির মেয়ে বুন্নিটাকে খুব মিস করি। ইমরানকে ছেড়ে আসার চেয়েও বেশি কষ্ট হয়েছে ওর জন্য। বাচ্চাদের সাথে আমি খুব বাচ্চামি করতে পারি কিনা, ওই বাসায় যাওয়ার কয়েকদিনের ভেতরই আমি তাই ওর জানি বন্ধু হয়ে যাই। সারাক্ষণ ওর সঙ্গে খেলা, দুষ্টুমি, এটা-সেটা নিয়েই থাকতাম। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে রাত্রেও বুন্নি আমার কাছে ঘুমানোর জন্য চলে আসত। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে, কোনদিন গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে তবে ছাড়া পেতাম। আহারে সোনাটা, না জানি তোর পরানটা এখন কেমন করে!

সি রি রি…।
নাইটগার্ডের বাঁশি বেজে ওঠে। যাক লোকটা তাহলে সুস্থ। গতকাল থেকেই আমার মনটা খুব খারাপ। ছোটপা রাগ করে চলে যাওয়ার পর থেকেই। আমরা অনেকগুলি ভাইবোন। সবাই যার যার সংসার নিয়ে আছে। কেবল সেজভাই আম্মা-আব্বা ও আমাদের দুই বোনকে নিয়ে থাকে। সে অফিস থেকে ফ্ল্যাট পেয়েছে। আম্মা-আব্বা সবসময় যে এখানে থাকে তা না, আজ এ বোনের বাড়ি, কাল ও ভাইয়ের বাড়ি, এরকম ঘোরাঘুরির ভিতর আছে। আমরা স্বামী ছাড়া দুই বোন কোথায় আর যাব, এখানেই থাকি।

কাল ছোটপার সাথে সেজভাইর একটা বিষয়ে তর্কাতর্কি শুরু হয়। সেজভাই ফট করে বলে বসে, দেখেন, এটা আমার বাসা, এখানে থাকতে হলে আমার কথা মতো চলতে হবে, আপনার যদি না পোষায় যেখানে খুশি যেতে পারেন। এই কথার পর ছোটপা রাগে ক্ষোভে ঘরে ঢুকে ধুপধাপ সুটকেস নামায়। ওয়ার্ডরোব-আলমারি খুলে তার কাপড়-চোপড় যা পেয়েছে সুটকেসে ঢোকায়। তারপর বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে গটগটিয়ে বের হয়ে যায় বড়আপার বাসার উদ্দেশে।

আচ্ছা, ছোটপার কাপড়-চোপড়ের সাথে আমার দু-একটা চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু না। আমার কাপড়-চোপড়…ফ্রক…। আরে মনে পড়েছে! আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে নামি। আলো জ্বালাই। পাগলের মতো আলমারির সেই রোয়াকটা খুঁজি। আমার সোনামণির জামাটা যেখানে রাখা ছিল। নেই! ও আল্লাহ! ওটা তাহলে ছোটপা নিয়ে গেল! চারবছর ধরে আমার সোনাকে আগলে আছি! এটা তুই কি করলি আপা? আমি মাটিতে বসে পড়ি।

আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে। নিউমার্কেট গিয়েছি স্ক্রাব কিনতে। একটা দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হুট করে একটা ফ্রকে চোখ আটকে যায়। লাল টকটকে। সুন্দর ফুলের কাজ করা। খুব সিম্পল। কিন্তু কী সুইট দেখতে! দু বছরের বাচ্চার ফ্রকটা আমি নেড়েচেড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হুড়মুড় করে একটা কষ্টও বুকে বিঁধল। আমার কেন একটা বাবু নেই? একটা ছোট্ট সোনামণি থাকলে এই সুন্দর ফ্রকটা পরাতে পারতাম। ফ্রকটা এতো নেড়েচেড়ে রেখে যেতে খারাপ লাগছিল। একদিন তো বাবু হবেই। কিনে ফেললাম। ফ্রকের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল আমি একটা ছোট্ট প্রাণ নিয়ে যাচ্ছি। এত ভাল লাগছিল। পৃথিবীতে এ আনন্দ আগে কখনো অনুভব করিনি, যেন আমার সোনামণিকে নিয়েই হাঁটছি। ছোট্ট দু পা টেনে টেনে এক হাতে আমার কড়ে আঙুল ধরে আমার মা হাঁটছে। মাথাটা ক্ষণে ক্ষণে তুমুল কৌতূহলে এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে। আধোবোলে বলছে, মা মা, উ-ইটা নিবো..। আমার চোখে পানি এসে যায়।

আমার বিয়ে হয়েছে তারও বছর খানিক বাদে। অবশ্য ফ্রকটার কথা ছোটপা ছাড়া কাউকে বলিনি। পৃথিবীতে ওকেই যে সবচে বেশি ভালবাসি। ইমরানের বাসা থেকে পুরোপুরি চলে আসার পরে একদিন ছোটপাকে বললাম, আমার তো অনিশ্চিত, তোমার বাবু হলে ফ্রকটা ওকেই পরাবো।

ছোটপার ততদিনে একটা সম্পর্ক হয়েছে। এবং শিগিগিরই তাদের বিয়ে হচ্ছে। ছেলেটাকে আগের ঘটনা সব খুলে বলার পরও রাজি। শুধু সতর্ক করেছে, এ কথা তার পারিবার যাতে ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। আমার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, আমার হাজব্যান্ড বিদেশে, তাই ভাইয়ের বাসায় থাকি। সত্য বড় কঠিন। দু দুটো বোনের একি পরিণতি কেইবা ভালভাবে নেবে? অবশ্য চেনা-পরিচিতদের কাছে একটা মিথ্যার বলয় আমাকে মেনটেন করতেই হয়। দেখা হলেই তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চরম কৌতূহলে স্বামী, সংসারের খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে। আমিও হু হা করে কাটিয়ে দেই। দ্রুত সামনে থেকে কেটে পড়ি। কারণ মুখে যতই তারা আফসোসের ভাব দেখাক, ভিতরে ভিতরে এসব শুনে তারা দারুন আনন্দ পায়।

কপালে যে আমার কী আছে কে জানে। দশ মাসের মাথায় কিছুদিন আগে পারিবারিকভাবে ইমরানের সাথে ডিভোর্স হল। আরও কিছুদিন এটাকে ঝুলিয়ে ওকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের চাপের কারণে দিতে হল। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে ইমরান এখনও আমার স্বামী। কী অদ্ভুত নিয়ম! আমি আবার বিয়ে করলে এটা পাল্টে নতুন স্বামীর তকত লাগাতে হবে। কেন? ছেলেদের মতো মেয়েদের বেলায়ও বাবার নাম লিখলে অসুবিধা কী?

ছোটপা চলে যাওয়াতে একটা মানুষ রইল না যার সাথে সব শেয়ার করা যায়, মন খুলে দু-চার কথা বলা যায়। ফ্রকটা থাকলেও ভাবতাম, যাক আমার বাবুটা তো সঙ্গে আছে। শয়তানটা সেটাও নিয়ে গেল। না হয় বলেছিলাম, তোর বাবু হলে এটা ওকে পরাব। তাই বলে নিয়ে যেতে হবে? এত ছোট মন!

সবাই কেমন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার সোনামণিটাও গেল! এত কষ্ট নিয়ে মানুষ বাঁচে কীভাবে? ধুঁকতে ধুঁকতে কেবল একটা খোলস নিয়ে টিকে থাকা?

দপ করে সব অন্ধকার। এত রাতে বিদ্যুৎ চলে গেল। আলমারির খোলা ডালাটা বন্ধ করে আমি ক্লান্ত শরীরটা টেনে বিছানায় এলিয়ে দেই। গাঢ় আধাঁরে ঘরটা ডুবে গেছে। চকচকে কাল-আলোতে কিছুই ঠাহর হয় না। জোরে চোখ রগড়াই। চোখ খুললে সব লালে লাল। তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যথা টনটনিয়ে ওঠে। বিয়ের পরপরই আমার ভিতরে একটি প্রাণ এসেছিল। মাত্র একমাস। অন্ধকার ভালবেসে ও আর আলোতে আসেনি। আজকাল যে কী হয়েছে, আগে অন্ধকারে আমি ভয় পেতাম, দম বন্ধ হয়ে আসত। অথচ এখন অন্ধকারেই স্বস্তি বোধ করি। তাতে যে খুব সহজে মিশে যাওয়া যায়। আলোর যন্ত্রণা অনেক।

ভাদ্র ১৪১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *