গল্প, বাংলা

ঘরে ফেরা

আমাদের এক সিনিয়র মহিলা কলিগ আছেন। এই তো সেদিন হঠাৎ তিনি অফিসে অনুপস্থিত। পরদিন তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, আমার রুমিটা আর নেই! কদিন ধরেই শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু তাই বলে আচমকা এমনভাবে মারা যাবে কেউ ভাবতেই পারিনি। বলে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন।
সিনিয়র কলিগের পাশে বসা তৃষ্ণাদি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেন, থাক আপা, সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছা, কেঁদে আর কী করবেন, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী?
রিপনভাই তখন ফিসফিসিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, রুমি কে? ওনার ছেলেমেয়ে কেউ নাকি?
ছেলেমেয়ে কেউ হওয়ার কথা না, অন্য কেউ হবে।
তৃষ্ণাদি আমাদের ফিসফিসানির কারণ বুঝতে পারলেন, আপাকে জিজ্ঞেস করেন, আপা, রুমি.. কে? আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ?
রুমি! ও আমার ছেলেমেয়ের চেয়ে কিছু কম ছিল না গো। ওকে খাইয়ে তারপর আমি খেতাম। ও নাই, দুদিন ধরে আমার খাওয়াদাওয়াও বন্ধ। হায়রে, দুনিয়াটা কেন যে এমন হয়! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি উদাস দৃষ্টিতে সামনে কী দেখতে থাকেন।
আমরা বুঝলাম রুমি তার ছেলেমেয়ে না হলেও সেরকমই কেউ হবে, যাকে তিনি খুব ভালবাসতেন।
তৃষ্ণাদি এবার উসখুস করেন, আপা, রুমি তাহলে কে?
আপা মুখ ঘুরিয়ে তৃষ্ণাদির দিকে অচেনা-দৃষ্টিতে তাকান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমার বিড়াল।
‘আমার বিড়াল’ শব্দ দুটি উচ্চারণ মাত্রই মুহূর্তে একটা জোয়ার উঠে গেল। কারও মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক ‘হ্যাঅ’, কারও মুখ দিয়ে অল্প হাসি, কারও মুখচাপা হাসি, অথবা কারও ‘হো হো’ হাসিতে বাতাসটাই আচমকা দুলে উঠল। তাও বড়জোড় দুই-তিন সেকেন্ড। আপা এমন আহত-দৃষ্টিতে আমাদের দিকে একে একে তাকালেন যে ফুলানো বেলুন চুপসানোর মতো দ্রুত আমরা সবাই চুপসে গেলাম।
সেই গল্পটাই এখন চায়ের আসরে আবার উঠেছে। চা খেতে খেতে এক চোট হেসে সবাই চাঙ্গা হয়ে উঠছি আর কী। তবে তুহিন বিষয়টিকে হাসি-ঠাট্টার বিষয় হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। সে সিরিয়াস হয়ে বলে, তাহলে শোনেন রুস্তমের গল্প।
রুস্তম?
হ্যা, আমাদের গ্রামের বাড়িতে কুকুর ছিল একটা।
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। কীভাবে শুরু করবে ভাবছে তুহিন।
এই রুস্তম আমাদের ভাষা বুঝত। তুহিন বলতে থাকে।
কী রকম?
এই ধরেন, এদিকে আয়, ওদিক যা, এসব তো বুঝতই, তারপর যদি বলতাম, চল আমার সাথে বাজারে চল, আব্বা কোন জায়গায় দেখতো। আমাদের বাড়িটা বেশ বড়, আব্বা হয়ত বাড়ির পিছনে, সেখানে গিয়ে তখন রুস্তম ডাক ছাড়ত। বুঝতাম আব্বা বাড়ির পিছনে। এরকম আর কী।
রুস্তম একটা পিস ছিল বলতে হবে। ওর ডরে কোনো অপরিচিত মানুষ, আমাদের আত্মীয়স্বজনও বাড়িতে আসতো না। আরেকটা মজার বিষয় ছিল, আমাদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে কোনো কুকুরকে যেতে দেখলেই হয়েছে। ওর একদিন কী রুস্তমের একদিন। সেই কুকুর দৌড়াইয়া যদি তাড়াতাড়ি যেতে পারে তো ভাল, নাইলে ওটারে রক্তাক্ত না করে ও ছাড়ত না। এটা ওর কাছে একটা খেলার মতো ছিল।
ইন্টারেস্টিং তো। আচ্ছা, রুস্তম নামটা দিল কে?
ওহ রুস্তম? আমার আব্বা। সে আবার ছোটবেলায় খুব যাত্রা দেখত। সোহরাব-রুস্তম ছিল তার প্রিয় পালা। সেখান থেকেই দিয়েছে।
যাহোক, রুস্তম আমার খুব ন্যাওটা ছিল, যেহেতু আমি বেশি আদর করতাম। তা, ওকে নিয়ে সমস্যা ছিল ওইটাই। অপরিচিত কাউকে সে বাড়িতে কিছুতেই ঢুকতে দিত না। কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে হয়েছে, কামড়িয়ে কাপড় ছিঁড়েটিরে শেষ। ধরেন, বাড়িতে আমরা দুইভাই হয়ত নাই, আব্বা ঘুমে, মা পাকেরঘরে। সেই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ আসলে মা পাকঘর থেকে এসে রুস্তমরে থামাতে থামাতে ততক্ষণে ওই লোকের দফা রফা। এক্কেরে বিদিক অবস্থা করে ফেলত। এজন্য আত্মীয়স্বজনরা ছিল দারুণ ক্ষ্যাপা। স্বাভাবিক, খালি ওর যন্ত্রণাতেই অনেকে আমাদের বাড়িতে আসত না।
তা মেনে নেয়া গেল, পরে একসময় যেটা সমস্যা দেখা গেল, ও মুরগি ধরে ধরে মেরে ফেলে। খায় না কিন্তু। খালি মেরে ফেলে। কল্লা আর শরীর আলাদা করে ফেলে। এরকম আশেপাশের বাড়ি থেকে মাঝেসাঝে নালিশ আসতে লাগল। শাসন করতাম। এরকম শুনলে হালকা মাইর দিতাম। খাওয়া দিতাম না। কিছুদিন ভাল থাকত। পরে যেই লাউ সেই কদু। আবার একদিন হুট করে কারো বাড়ি থেকে নালিশ আসত। আসলে ওর জানি কী হয়েছিল সে সময়। পাগলামি না, কেমন জানি, একটু অন্যরকম। আমাদের যেমন এক-দুই রাত না ঘুমালে, কয়েকদিন দাড়ি না কাটলে, কেমন উস্কোখুস্কো লাগে না? চোখেমুখে একটা পাগলামি ভাব চলে আসে। রুস্তমের মধ্যেও একটা ওইরকম ভাব চলে এসেছিল। দুই-তিন মাস ধরে এরকম মুরগি মেরেছে। এইসময় বিড়ালকেও সে একদম দেখতে পারত না। আগেও পারত না, কিন্তু তখন শুধু দাবড়ানি দিত। পরে দুই-তিনমাসের ওই সময়টায় বিড়াল দেখলেই জানে মেরে ফেলত। বেশ কয়েকটারে এরকম মেরেছে। তবে এরকম কোনো ঘটনা ঘটানোর পর একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম ওর মধ্যে। যেমন ওইদিন পারতপক্ষে আর আমার চোখের দিকে তাকাত না। মাথা নিচু করে চোখ নামিয়ে রাখত। কাছে ডাকলে সবসময় যেমন দৌড় দিয়ে আসত, ওইরকম আসত না। আস্তে আস্তে পা ফেলে, অপরাধী মুখ নিয়ে ভয়ের সাথে আসত।
তার মানে সে বুঝতে পারত সে অপরাধ করেছে।
হ্যা। তারপর ও একদিন করল কী, আমাদের নিজেদের বাড়িরই একটা ডিমপাড়া মুরগি মেরে ফেলল। আমি তখন স্কুলে। বিকালে স্কুল থেকে এসে এই খবর শুনে মাথা গেল গরম হয়ে। ছোটভাইরে বললাম, দড়ি নিয়া আয়, আজকে ওরে জনমের শিক্ষা দিমু। রুস্তমরে কষে গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। তারপর একটা মোটা চেলাকাঠ নিলাম। এলোপাথারি শুরু করলাম পিটানি। চেলাকাঠ বুঝেন? এক্কেবারে সাথে সাথে কালশিরা পড়ে গেল। তবে আজব ব্যাপার কী জানেন? এতো মারলাম, ব্যাটা সব চুপ করে হজম করল। আছে না অনেক সময়, মাইর খেতে খেতে ক্ষেপে উঠে? না, ও একটা টু শব্দও করল না, এক্কেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে মার খেতে লাগল। আমার তো মেজাজ বেজায় গরম হয়েছিল, ওর জন্য আত্মীয়স্বজনের কাছেও আমার কথা শুনতে হত।
তো সবকিছু মিলিয়ে মাথা সেদিন হট। পিটাতে পিটাতে ঠিক করলাম শালারে আজকে মেরেই ফেলব। আধাঘণ্টা পরে ও আর দাঁড়াতে পারল না, আধমরা হয়ে মাটিতে প্রায় শুয়ে পড়ল। একঘণ্টার মতো ইচ্ছামত পিটালাম। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত তো বের হয়েছেই, সারা শরীরও রক্তাক্ত হয়ে গেছে। পরে আমার কাছে একটা বিষয় খুব অবাক লেগেছে। পিটানি শুরু করার কিছুক্ষণ পরে বানগুলো মানে দড়ির বাঁধনগুলো ঢিলা হয়ে গেছিল। ও কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই পালাতে পারত। ব্যাটা তা করে নাই, চুপ করে ভোন্দার মতো মাইরগুলা খেয়েছে। যাইহোক, মারতে মারতে এক পর্যায়ে মেরেই ফেললাম।
মেরে ফেললেন? আমি, রিপনভাই দুজনেই একসাথে প্রায় চেচিয়ে উঠি।
শোনেন, আরো কাহিনী আছে। এরপর ছোটভাই আর আমি মিলে রুস্তমরে ধরে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে খালপাড়ে ফেলে দিয়ে আসলাম। ব্যস, ঘটনা খতম। কিন্তু শালা মরে নাই আসলে, অজ্ঞান হয়ে গেছিল। পরে রুস্তম যেটা করল, খাল তো, ব্রিজের ওইপারে চলে গেল। ওখানে সরদার বাড়ির একটা বিশাল মাঠের মতো জায়গা ছিল। সেখানেই সে থাকত আর কী। আমাদের বাড়িতে আর আসে নাই।
আর আসে নাই? একবারের জন্যও না?
নাহ, আর আসেই নাই। এবং তখন থেকে ও খুব শান্ত হয়ে গেছিল। আর কাউকে কখনো কামড়িয়েছে বলে শোনা যায় নাই। চুপচাপ থাকত। কেউ খাবার দিলে খেত, নইলে না। মানে একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিল আর কী।
অদ্ভুত তো! এত বিশাল চেঞ্জ!
হু। এখনও শেষ হয় নাই। আসল কাহিনীই তো রয়ে গেল।
আসল কাহিনী কী?
রুস্তমের মৃত্যু। শেষটা এরকম না ঘটলে এই কাহিনী আমি আপনাদের বলতাম না। রুস্তম বছর দুয়েক বাদে একদিন আমাদের বাড়িতে ফিরে আসল। আমি তখন ঘরের দুয়ারে বসে আছি। দেখলাম বাড়িতে ঢোকার মুখে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সীমানায় ঢোকেনি কিন্তু, রাস্তার ওপরে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুড়ো হয়ে গেছে, গায়ের লোম অর্ধেক ঝড়ে গেছে, দুর্বল শরীর। আমি দেখে চিনলাম, গায়ের রঙ তো আর বদলায়নি। হাত ইশারা করে ডাকলাম। আস্তে আস্তে ভিতরে আসল, চোখ ঘুরিয়ে বাড়ির এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে। আমার তিন-চার ফিট সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি দুয়ার থেকে নিচে নামলাম। নামা মাত্রই আমার পায়ের মধ্যে এসে মুখ ঘষা শুরু করল আর কান্না। বিশ্বাস করবেন না, সে কী কান্না রে ভাই, কী বলব। এমন আবেগী, দরদী কান্না! মা যেমন অনেকদিন পরে তার হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়ে চুমোয় চুমোয় মুখ ভরিয়ে আনন্দের কান্না কাঁদে, রুস্তমও ঠিক সেরকম করেই কাঁদছিল। ওর কান্নার শব্দে বাড়ির ভিতর থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। এমন করে কাঁদল, আমার নিজেরই কান্না চলে এসেছে। আমি তো পুরো তাজ্জব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।
যাহোক, তারপর বাড়িতেই থাকল। আমরা একটু আদর-যত্ন করার চেষ্টা করলাম। এতদিন পরে আমাদের মনে করে ফিরে এসেছে। মানুষই মনে রাখে না, আর ও সামান্য প্রাণী হয়ে মনে রেখেছে! কিন্তু সপ্তাহ খানেক ছিল মাত্র। তারপর এক সকালে উঠে দেখি মারা গেছে।
শুনে দুজনেই তুহিনের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম, মুখ দিয়ে হঠাৎ কোনো কথা বেরুল না।

ফাল্গুন ১৪১৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *