Uncategorized

টিকটিকি

টিকটিকিটা আমার সঙ্গী, সারাটা দিন বাসায় একলা থাকি, ও ছাড়া আর কে আছে ?

কী যে তুমি কও না, টিকটিকি আবার কারো সঙ্গী হতে পারে নাকি ! শোনো, এটাকে মেরে ফেলি, বাথরুমের সুইচ টিপতে গেলেই বিরক্ত লাগছে।
না না, প্লিজ মেরো না, টিকটিকি মারা ভালো না। এমনেই দেখবা সরে গেছে।
ঝাড়– হাতে নিয়ে মারতে উদ্যত হয়েও শেষ পর্যন্ত লাজুর আর্জি রাখতে গিয়ে টিকটিকিটা আর মারা হয় না, যদিও ছোটবেলায় অনেক টিকটিকি মেরেছিলাম, বহুগুলার খালি লেজও খসিয়েছি। মারব না কেন, নবীজী একবার কাফেরদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একটা গুহায় গিয়ে লুকায়, একটা বড়ো মাকড়সা তখন গুহামুখ আকঁড়ে নবীজীরে প্রটেকশন দেয় ; সেইখানে শালার গুহার ভিতরের টিকটিকিটা কিনা টিকটিক শব্দ করে নবীজীরে ধরাইয়া দিল ! দাদির মুখে এ গল্প শোনার পর টিকটিকি দেখলেই মারতাম। আর একটা টিকটিকি মারলে নাকি সত্তর নেকি সওয়াব পাওয়া যায়। তবে বাথরুম বা ঘরের ভিতর বড়ো বড়ো মাকড়সা দেখে ভয় লাগলেও মারতাম না। বড়ো হয়ে অনেক কুসংস্কারমুক্ত হতে পারলেও শৈশবের বিশ্বাসের বৃত্ত ভাঙতে এখনো সংকোচ লাগে।
সকালে অফিসে যাওয়ার সময় খেয়াল করেছিলাম বাথরুমের সুইচের পাশের ফিউজটার উপর একটা টিকটিকি। বাথরুমের সাথে বেসিন, সুইচ টিপলে ওটা ক্ষিপ্র গতিতে বেসিনের আয়নার ফাঁকে ঢুকে যায়। তখন আমল দেই নাই, কিন্তু রাতেও বাসায় ফিরে টিকটিকিটাকে একইভাবে ফিউজে বসে থাকতে দেখে খটকা লাগল, হয়েছেটা কী ? আশেপাশে এটা কোথাও ডিম পেড়েছে নাকি ?
আচ্ছা, একটা জিনিস খেয়াল করছ, লাজুকে বলি, একটা টিকটিকি সকাল থেকে ঠিক এই জায়গাটায় বসে রইছে। একটুও নড়ন-চড়ন নাই, খালি সুইচ টিপতে গেলেই দৌড় দেয়।
সকাল না, কালকে রাত থেকেই এরকম। তোমার তো কিছুই চোখে পড়ে না, লাজু টিপ্পনি দেয়, যাক, তবুও ভালো যে একদিন পর চোখে পড়ছে। ঘরে আমি যে একটা প্রাণী সারাদিন একলা থাকি মাঝে মাঝে সেইটাও তো ভুলে যাও।
কী কথার কী উত্তর ! ওকে বলাটাই ভুল হয়েছে। আমি টিকটিকিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। লাজুর নকিয়া সেটে টর্চ আছে, ফিউজের ডান পাশের সকেটে টর্চ মেরে দেখি : না, ডিম জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে না।
আচ্ছা, তোমার বিয়ে করার দরকারটা কী ছিল বল তো ? সকাল আটটায় যাও, রাত নয়টা-দশটায় আস। বিয়ের আগের আর এখনকার জীবনে আমি তো কোনো চেঞ্জ দেখি না, পার্থক্য খালি রাতে একসাথে ঘুমাই, তারচে’ বিয়ের আগেই অনেক সময় দিতা।
ওহ, এমন বোকার মতো কথা বল ক্যান ? তুমি যেভাবে বলতেছ মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছা করে বাইরে থাকি, তাইলে ঠিক আছে, তোমারে সময় দেয়ার জন্য এখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে না খেয়ে থাকি, নাকি?
তারপর এসেই শুরু হয় তোমার এমবিএ ! বাসায় এসেও আমার সাথে কথা বলার সময় থাকে না। লাজুর কণ্ঠ আর্দ্র হয়।
এখন তো বিবিএ-এমবিএ-র যুগ। এমবিএ-টা শেষ করতে পারলে আরো ভালো চাকরি পাব, বেশি বেতন পাব। অ্যাতো টাকা দিয়ে ভর্তি হলাম, পড়াশুনা না করলে তো ফেল করব। খামাখা টাকা নষ্ট করে লাভ আছে ?
লাজু এবার শুয়ে পড়ে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কম্বল টেনে নেয়। বিয়েতে পাওয়া কম্বল। লালের ওপর ক্রিম কালারের ফুল, পাতা, আর চিতার গায়ের মতো অসংখ্য ফোঁটা। এত সুন্দর মখমলের মতো জিনিস আসলে গায়ে দিতে ইচ্ছা করে না, দেয়ালে টাঙানো গেলে বেশ হত। কম্বলাবৃত লাজুকে চমৎকার লাগছে, মনে হচ্ছে ফারকোট পরা জড়সড় কেউ।
শুধু শুধু কে কষ্ট করতে চায়, অফিস থেকে এমবিএ-র ক্লাস শেষে বাসায় এসে আমার কি ইচ্ছা করে না তোমারে নিয়া একটা মুভি দেখতে বসি ? যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর ! কথাটা মনে মনে রেখে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলি। ওর কথা চিন্তা করেই এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছিলাম, সিঙ্গেল থাকলে কার এইসব ঠেকা পড়েছিল ! সন্ধ্যাবেলা বগল বাজাতে বাজাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে যেতাম। দেড়মাস হল লাজুর ছোটবোনটার বিয়ে হয়েছে, জামাই কোটিপতি ; ঢাকা শহরে বাড়ি আর জায়গার অভাব নাই, গাড়ি তিনটা। হানিমুনে গিয়েছিল মরিশাস। নাজুর কাছ থেকে মরিশাসের গল্প শুনে কয়েকদিন শুধু ওই প্যাচাল পেরেছে। শুনে হিংসা হত, রাগ তো লাগতই। শালার বাপের এরকম সম্পত্তি পেলে আমরাও বউ নিয়া বাইরে মউজ করতে যেতাম। নাজুর জামাইর নিজের কৃতিত্বটা কোথায় ? বাপের বিশাল সম্পত্তি নেড়ে-চেরে খাচ্ছে, এই তো ? শেষে বিরক্ত হয়ে লাজুরে কথা দিলাম, শোনো যদি বেঁচে থাকি তাইলে নাজুগো মতো আমরাও একবার মরিচ দেশে যাব।
শ্বশুরবাড়িতে গেলে এখন শ্বাশুড়ির মুখে সারাদিনই নাজুর জামাইর প্রশংসা। মরিশাস থেকে দুই-চারটা জিনি পেয়ে শ্বাশুড়ি একেবারে খুশিতে গদগদ। আসলে টাকাই সব !
টিকটিকিটার লেজটা এমন ক্যান ? মনে হয় কাটা পড়ছে, না ? লাজু চায়ের কাপ টেবিলে রেখে আমার মতামত প্রত্যাশা করে।
টিকটিকিটাকে তখন খুঁটিয়ে দেখেছিলাম, ঈগলচোখে লেজের খুঁতটাও খেয়াল করেছি, তাই টেবিলে বইয়ের মাঝে চোখ রেখেই উত্তরটা দিলাম, প্রথম দৃষ্টিতে তাই মনে হয় কিন্তু ভালোমতো তাকিয়ে দ্যাখো, লেজের শেষটা দ-য়ের মতো। কাটা না।
খাওয়ার পরপরই সিগারেটখোরদের যেমন সিগারেট, আমার এক কাপ চা। অনেকের রাতে চা খেলে ঘুম হয় না, আমার বরং উল্টোটা। আগে অবশ্য এত চা খেতাম না ; বিয়ের পর বন্ধু-বান্ধবের সাথে কালেভদ্রে মদ খাওয়া তো ছাড়তে হলই, এমনকি বহু কষ্টে সিগারেটও। পৃথিবীতে নাকি কোনো কিছুর ধ্বংস নাই, শুধু রূপান্তর ঘটে। আগে যে আসক্তি ছিল সিগারেটের প্রতি, এখন তা চায়ের প্রতি।
হু। লাজু চশমা চোখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
ধুর, চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, একটা ঝাড়– নিয়ে দুইটা বাড়ি দাও তো, খামাখা এইটা বিরক্ত করতেছে।
দেখছ, এ সামান্য টিকটিকিটাও বুঝে গ্যাছে তুমি কতটা পাষাণ, কথাটা বলার সাথে সাথেই আয়নার তলে চলে গ্যাছে।
লাজু টেবিলমুখি হয়ে বিছানায় এসে বসে। নিঃশব্দে আমাকে কিছুক্ষণ দেখে, তারপর থেকে থেকে বলে : অ্যাই, শোনো না, পড়া শেষ হয় নাই ? চলো ঐ নাটকটা দেখি। কী হবে পড়ে, অ্যাতো টাকা দিয়ে ? জীবনে যদি আনন্দই না থাকল ! আমার নিরুত্তর মূর্তি দেখে এবার ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, টিকটিকিটা যেমন আয়নার তলে যায়, একদিন আমিও কোথাও চলে যাব যাতে তুমি আর খুঁজে না পাও। ভালোই হবে, কেউ তোমারে বিরক্ত করবে না, কাছে আসতে বলবে না ; সারাদিন তোমার কাজ আর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারবা।
কিশোরী মেয়ের মতো অভিমানী কণ্ঠ আমাকে স্পর্শ করে, খোলা বইয়ের উপর পেপার ওয়েট চেপে চেয়ার ছেড়ে উঠি। বিছানায় লাজুর পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরি। হালকা গোলাপি রঙের কামিজটাতে ওকে সুন্দর লাগছে, একটু আগে মুখে পানি দেয়ায় গালের ত্বকে উজ্জ্বলতা, দুপুরে শ্যাম্পু করা সিল্কি-চুলে টিউবলাইটের আলো গড়িয়ে পড়ছে। কোমল গালে গাল ঘষে ঠোঁটে চুমু দিতে গেলে ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়, যাও, পড়তে যাও, আহ্লাদ দেখাতে হবে না। আমার কাছে আসলে আজকের মতো কালকের পরীক্ষায়ও সি গ্রেড পাবে। যাও পড়গা।
পাইলে পাব, তুমিই যদি না থাক তাইলে ওইসব দিয়া কী করব ?
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে জড়িয়ে থাকলে লাজু কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়। নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর মাথায় হাত বুলাই, কিন্তু ভিতরে তাড়া অনুভব করি : বারোটা বেজে যাচ্ছে, ঘুমাতে হবে, পড়া তেমন হল না, ফ্রিজে নাকি কিছু নাই, ভোরে উঠেই যেতে হবে বাজারে, কালকে অফিসেও দৌড়াতে হবে আগে আগে, চীন থেকে ডেলিগেট আসতেছে..।
আচ্ছা, তুমি আমারে একটা চাকরি দিতে পারো না ? সারাদিন বাসায় একলা থেকে একসময় তো মানসিক রোগি হয়ে যাব। লাজু মাথা উঠিয়ে আমার চোখে চোখ রাখে।
অনার্স পাস না করে কী চাকরি করবে, টুকটাক কিছু করা যায় কিন্তু ওইসব সামান্য বেতনের চাকরি করার চেয়ে না করাই ভালো। একটু থেমে নরম সুরে বলি, অনেক দিন তো ইউনিভার্সিটি যাও না, ইয়ার ফাইনাল কবে ? খোঁজ-খবর রাখতেছো ?
কত দূর ইউনিভার্সিটি, যেতে ভালো লাগে না ; আগে তো যাহোক তুমি ছিলা, একলা লাগত না।
কেন, তোমার বান্ধবীরা আছে না ?
ওরা নিজেদের প্রেম নিয়া ব্যস্ত, লাজুর কথার তলে দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ ওঠে, আমার সাথে কথা বলার সময় পায় না।
আমার চোখে মৃতব্যক্তির খোলা চোখের মতো শূন্যতা, ভাবতে থাকি কী করা যায় : লাজুর একাকীত্বের যন্ত্রণা লাঘবে এবং কয়েকবার এর সমাধানকল্পে দুজনে মিলে কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, যেমন প্রতি শুক্রবারে আমরা কোথাও ঘুরতে যাব, অফিস শেষে যেদিন এমবিএ-র ক্লাস থাকবে না বাসায় এসে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ওর সাথে সময় কাটাব ইত্যাদি। দুই-তিন সপ্তাহ এইরকম চলার পর উৎসাহে ভাটা পড়ে। বাংলাদেশে প্রণীত অসংখ্য আইনের মতো আমাদের প্রকল্পও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
লাজু হতাশাবাদী একজন মানুষ, জীবনের কোনো মানে ও খুঁজে পায় না, এ পৃথিবী, মানবজন্ম, বেঁচে থাকা সবকিছুই ওর কাছে বিষাদময়। বহুবার তর্কে জীবন সম্পর্কে আমি ওকে একটা পজিটিভ ধারণায় না আনতে পেরে শেষমেষ ফ্রয়েডের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ওর কৈশোর যে অবরুদ্ধতার ভেতর কেটেছে, ধর্মের যাতাকলে ওর সমস্ত ভালো লাগা শখ যেভাবে পিষ্ট হয়েছে ; মানুষের নিষ্ঠুরতা, কঠোর শাসন আর না-পাওয়ার বেদনাগুলো ক্রমে তাই ওকে জীবনবিমুখ করে দিয়েছে।
আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পৃথিবীটা কত সুন্দর, কত কিছু দেখার আছে এখানে, জীবনটাকে উপভোগ না করে, কিছুই না দেখে, না করে তুমি চলে যেতে চাও ?
এসব মিথ্যা স্বপ্ন দেখে কী লাভ ? লাজু বিষণœ গলায় তেতে ওঠে, ছোটবেলা থেকে কোনো স্বপ্নই আমার কখনো পূরণ হয় নাই, আমার সব স্মৃতিই শুধু দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। ছোটবেলায় শিশু একাডেমিতে গানে ভর্তি করাইল কিন্তু আমার নাচ ভালো লাগত, গান বাদ দিয়ে আমি নাচের ক্লাস করতাম। আব্বা জানতে পেরে একাডেমি যাওয়াই বন্ধ করে দিল, বলে, মাইয়া মানুষ নাচ শিখখা কী করবি, নটী হইতে চাস, নটী ? গানের জন্য বাসায় একটা হারমোনিয়াম ছিল, মাঝে-সাঝে বাজাতাম, আব্বা তাবলিগ শুরুর পর ভেঙ্গে ফেলে ; খুব কষ্ট পাইছিলাম তখন। তারপর সময় কাটানোর জন্য ছবি আঁকতাম, একদিন আব্বা অনেকগুলো ছবি ছিঁড়ে বলে, ছবি আঁকাআঁকি এসব অনৈসলামিক কাজ যেন না করি। এরপর আমার সময়ই কাটত না, নিচের মাঠে অন্য মেয়েরা খেলত আমি তাকিয়ে দেখতাম, আমার যাওয়া নিষেধ কারণ ততদিনে আমি সিয়ানা হয়ে গেছি, আর সিয়ানা মেয়ের দৌড়-ঝাপ করা নিষেধ। আমি খুব চুপচাপ হয়ে গেলাম, নিজেরে শামুকের মতো গুটিয়ে নিলাম, বাস্তবতা থেকে দূরে সরে ধীরে ধীরে কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠলাম ; সময় কাটাতাম গল্পের বই পড়ে, আকাশ দেখে, জানালার পাশের গাছের সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলে। ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের জন্য স্কুল-কলেজে আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। এতটুকু বলে লাজু থামে, একটু হাসার চেষ্টা করে দীর্ঘ করে শ্বাস টেনে বলে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়া পর্যন্ত বই-ই ছিল একমাত্র সঙ্গী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হতে গিয়েও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে, ঢাবিতে চান্স পাই নাই, আব্বা কিছুতেই এত দূরে ভর্তি করাবে না। শেষে মা বড়ো চাচারে ধরে। আব্বা আবার বড়ো চাচার কাছে বিলাই, বড়ো চাচা এসে আব্বারে ধমক দিল, মানুষ ইউনিভার্সিটি চান্স পায় না, আর মেয়েটা চান্স পাইয়াও ভর্তি হইব না ক্যা ? কী এমন দূর সাভার ? নবীজী বলে নাই, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও ? আচ্ছাÑ, লাজুর কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করি, আমি তো ছোটবেলায় ছোট ভাইবোনদের সাথে খেলতাম, তুমি নাজুর সাথে খেল নাই ?
লাজু ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসির রেখা তৈরি করে, নাহ, ও ছোটবেলা থেকেই মায়ের ফটোকপি, সাজগোজ, পরচর্চা আর স্বার্থপর সব চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত, ওর সাথে আমার কখনোই মিলতো না।

আচ্ছা, চুলে বিলি কাটা আমার আঙুল থামিয়ে দিয়ে লাজু মাথা সোজা করে। দেশের থেকে আব্বা-আম্মাকে ঢাকায় এনে রাখলে কেমন হয় ?
সেটা তো আমিও চাই। তাহলে তোমারও আর একা লাগত না, কিন্তু যে ইনকাম তাতে দেড়রুমের এই ফ্লাটের ভাড়া দিয়ে, খাওয়া খরচ আর বিয়ের ধার শোধেই তো টাকা শেষ। তোমার ইচ্ছা হলে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তুমি থাকতে পারো, আমার আপত্তি নাই, কিন্তু প্লিজ, আমারে রাত্রে যেতে বলবা না ; তখন কয়দিন পর মানুষ ঘরজামাই ডাকতে শুরু করব। গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে খানিক বিরতি দিয়ে বলি, তুমি যদি আর দেড়-দুই বছর বিয়েটা ঠেকিয়ে রাখতে পারতে.. তাহলে মাস্টার্সটা শেষ করে চাকরি করে টাকা-পয়সা জমিয়ে তারপর..,
এখন আমারে দোষ দাও ক্যান ? তুমি বিয়ে না করলেই পারতা। লাজু উত্তেজিত হয়।
থাক, এখন আর এইসব আলোচনায় লাভ কী।
অনেকক্ষণ কথা এগোয় না। দুজনেই নিশ্চুপ। রাস্তা থেকে কেবল থেকে থেকে ভেসে আসছে গাড়ি চলাচলের শব্দ।
আসো শুয়ে পড়ি, লাজুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসে।
অ্যাতো তাড়াতাড়ি ? মাত্র ১২টা বাজলো। বলেই মাথা উঠিয়ে লাজু আমাকে দেখে। ইস, তোমার দেখি ঘুমে অবস্থা খারাপ। ঠিক আছে, তুমি দাঁত ব্রাশ করো।
ঝপাঝপ দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, ঠোঁটে ভেজলিন মেখে, লাইট নিভিয়ে যখন কম্বলের তলায় গেলাম ততক্ষণে ঘুম কেটে গেছে। লাজু আমার সাথে লেপ্টে বুকের ওপর মাথা রাখে, আমারে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেও না, তুমি তো একা একাই ঘুমিয়ে যাও। গলায় অসন্তুষ্টি মিশিয়ে বলে, কালকে শোয়ার এক-দেড় ঘণ্টা পর ঘুম আসছে। বিয়ের আগে তো বলতা, তোমারে রাত্রে ঘুম পাড়িয়ে দিব।
ঠিক আছে, চুলে হাত বুলাই, ঘুমাতে চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকো, দেখবা এমনেই ঘুম আসবে।
লাজু চোখ বুজে ওর আজকে দেখা ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ ছবির কাহিনী বলা শুরু করে। সেসব আমার কানে কিছুই ঢোকে না, আমি চুলে হাত বুলিয়ে চলি আর মাথায় কালকের চিন্তা-স্রোত ঘূর্ণি খায় : পড়া হল না, কালকের পরীক্ষায়ও সি পাব, ফ্রিজে কিছু নাই, ভোরে উঠেই যেতে হবে বাজারে, অফিসে দৌড়াতে হবে আগে আগে, চীন থেকে ডেলিগেট আসতেছে, মিজান ফোন করছে, ওর টাকাটা দিতে হবে..।


পৌষ ১৪১২
(জনকণ্ঠ, ৬ জানুয়ারি ’০৬)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *