গল্প, বাংলা

বিড়ালনামা

এক সকালে নাস্তার টেবিলে অবন্তি শুভকে জানায় সে একটা বিড়াল পালবে। কথাটা শুনে আমের জেলি মিশিয়ে পাউরুটি খেতে-থাকা শুভর মুখ হঠাৎ থেমে যায় এবং একই সাথে চোখ ছোট করে তাকায়। অবন্তি তখন তার হঠাৎ-জাগা এমন খেয়ালের কারণটা লাজুক হেসে শুভর কাছে খোলাসা করে। গতরাতে ঘুমের মধ্যে নাকি তার অনেক খাটাখাটনি গেছে। স্বপ্নে একটি বিশাল ধেড়ে ইঁদুরের দাবড়ানি খেয়ে সে যে কত শত মাইল দৌড়িয়েছে তা একমাত্র আল্লাই জানেন। বাস্তবে এমন দৌড় দিতে পারলে অনায়াসে তার নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে চলে যেত। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন তার একেবারে জান যায় যায় অবস্থা, আর কিছুক্ষণ বাদেই সে মুখ থুবড়ে পড়বে এবং ইঁদুরটাও তার ওপর হামলে পড়বে প্রায়, ঠিক এমন সময় কোত্থেকে একটি বিড়াল আচমকা এসে ইঁদুরটাকে ধরে ফেলে তাকে বাঁচাল।
স্বপ্নের গল্পটা শুনে শুভ ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগল, তাহলে তুমি স্বপ্নে বাণী পেয়েছ যে বিড়াল মানুষের বিপদে উদ্ধারকারী?
শুভর হাসির বাহার দেখে অবন্তির গা জ্বলে যায়, দ্যাখো, আমার স্বপ্নের ঘটনা অনেক সময় সত্যি হয়। ঘুমের থেকে ওঠার পরই আমার শরীর-হাত-পায় প্রচণ্ড ব্যথা। আবার ডান পায়ের একটা আঙুলে ফোস্কাও পড়ে গেছে। এত না দৌড়ালে কি এসব হত?

কাঁটাবনে শুভর এক বন্ধুর পেট এ্যানিমেলের দোকান আছে। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে সেখানে একটি মাঝারি সাইজের বিড়াল পাওয়া গেল। কাশফুলের মতো সাদা বিড়াল। বাড়িতে আনার পর অবন্তির খুশি আর দেখে কে? কাজের লোকদের ওপর তখনই মুহুর্মুহ হুকুমজারি হতে লাগল এই তাড়াতাড়ি দুধ নিয়ে আসো, কাচা দুধ না, হালকা গরম করে এনো, নাইলে যদি আবার ডায়রিয়া হয়ে যায়! আর জমিলা, তুমি তাড়াতাড়ি মাছ ভাজো, ইলিশ মাছ ডিপ থেকে নামাও।
সব মিলিয়ে একটা হুলস্থূল ব্যাপার। বিড়ালটি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ভীত-সতর্কভাবে আড়চোখে চারপাশ তাকাচ্ছিল। অবন্তি খুশিতে চেচিয়ে ওঠে, কী সুন্দর করে খাচ্ছে, দ্যাখো! কেমন একটা বাঘ-বাঘ ভঙ্গি না?
শুভ হেসে বলে, বাঘ-বাঘ তো লাগবেই, বিড়াল বাঘের খালা না?
বিড়ালটার একটা নাম রাখা হল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে, নামাভিধান ঘেঁটে-ঘুঁটে। লিও। শুভ আপত্তি জানাল, আরে মেয়ে বিড়ালের জন্য এটা তো পুরুষালী নাম হয়ে গেল। অবন্তি বলল, ধুর, নামের ক্ষেত্রে এখন আবার ছেলেমেয়ে কি?
কদিন লিওকে নিয়ে চলল ঘরে জম্পেশ আড্ডা-আলোচনা। কাজের মহিলা দুইজনার মুখেও লিওর কথা:
বুঝছছ জমিলা, বড়লোকের কাম দেখলে হাস আহে। এই বিলাইটার দাম বলে পাঁচশো টাকা। আরে রাস্তায়-ডাস্টবিনে কত বিলাই, আমারে বিশ টাকা দিলেই তো আমি একটা ধইরা আইনা দিতাম।
জমিলা বলে, বড়লোকে তো টাকা ফালানের জায়গা পায় না, বোঝ না? নাইলে বিলাইও বলে মাইনষে টাকা দিয়া কিন্না আনে! ছিঃ!
সারাক্ষণ আদরে আদরে থেকে দুদিনেই লিও অবন্তির খুব ন্যাওটা হয়ে গেল। একেবারে পায়ে পায়ে ঘোরে। মাঝে মাঝে হাঁটার সময় অবন্তির দু পায়ের ফাঁকে ঢুকে গেলে তখন অবশ্য হাঁটতে অসুবিধা হয়, তবুও ভাল লাগে অবন্তির। সব সময় পেয়াদার মতো সাথে সাথে একজন থাকা। আর অবন্তিও লিওকে ফেলে এক দণ্ড থাকে না, কোন কিছু খায় না। ভালো খাবারদাবার অতিরিক্ত খেয়ে কয়েকদিনেই লিও বেসম্ভব মুটিয়ে গেল। বড়লোকের বাড়ির বিড়াল বলে সহজে চেনা যায়।
লিও-অবন্তির এমন গলায় গলায় পিরিত দেখে শুভ বলে, এখন তো তোমার লিওকে আমার হিংসা হচ্ছে। ও যতক্ষণ তোমার সংস্পর্শ পায় আমি তো তার একশ ভাগের এক ভাগও পাই না।
কী যে তুমি বল না, লিওর সাথে তোমার তুলনা?
কেন করব না? ও ব্যাটা সারাক্ষণই তোমার সুন্দর হাতের আদর পায়, আর আমার চুলে কতদিন যে তুমি হাত বুলিয়ে দাও না সে খবর আছে?
অবন্তি হেসে ফেলে, লিওকে জিজ্ঞেস করে, কিরে তুই বলে আমার জামাইর প্রতিদ্বন্দ্বী?
লিও ক্ষীণস্বরে অবন্তির চোখের দিকে তাকিয়ে জানায়, মি-উ।
অবন্তিু খুশিতে চেচিয়ে ওঠে, জানো ও কি বলল? বলল, তোমার জামাই আমার সতীন।
শুভ ভ্রু কুঁচকায়, কী? এতো বড় কথা। খাল কেটে বাড়িতে আমি কুমির আনলাম? এখন আমাকেই তাড়াতে চায়, না? দাঁড়াও, লাঠি কোথায়, লাঠি দাও একটা।
এই এই, আমার লিওকে ভয় দেখাবে না। কোলে তুলে লিওকে দুহাতে আড়াল করে অবন্তি, আমার লিও সোনা খুব ভালো।
বিড়ালের প্রতি অবন্তির কখনোই তেমন দুর্বলতা বা ভাল লাগা ছিল না, সেদিক থেকে বরং কুকুরের প্রতি খানিকটা ছিল এবং ‘হলে ভাল না হলেও ক্ষতি নাই’ ধরনের একটা ইচ্ছা ভিতরে ছিল একসময় কুকুর পালবে। আর ঘটনা কিনা ঘটল উল্টাটা? লিওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে অবন্তি ভাবে, বিড়াল কী সুন্দর একটা প্রাণী, সে আসলে আগে বিড়ালকে ভালমতো লক্ষই করেনি, আর মানুষও আছে, বেহুদা বিড়ালের বদনাম করে! তার লিও দেখতে কী কিউট! নরম শরীরে মসৃণ মিহি সাদা চকচকে লোম, কেমন রাজকীয় ভঙ্গিতে নিঃশব্দে হাঁটে, লেজটা কী সুন্দর করে নাড়ায়, আদর দিলে মায়া-মায়া কণ্ঠে মিয়াও মিয়াও করে!
লিওর এমন জামাই-আদর দেখে কাজের লোকদের চোখ টাটাতে লাগল। একদিন লিওকে একা পেয়ে জমিলা একটা কষে লাথি মারে। মনে মনে গজরায়, শওতান বিলাই, আমার তিন বছরের পোলাডায় এট্টু দুধ পায়না খাইতে আর তুই ডেলি এক কেজি কইরা দুধ গিলছ। ভাগ শয়তান।
অবন্তিদের এপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটগুলোতে লিওর খবর পৌঁছতে দেরী হয়নি। তারা আড়ালে-আবডালে অবন্তির একটা নামও দিয়ে দিল বিলাইআলি।

দেড় মাস পরের কথা।
আশ্চর্য হলেও সত্য অবন্তির লিওপ্রীতির চিত্র এখন পুরো বিপরীত। লিওর প্রতি তার মহাউৎসাহ একটু একটু করে কমতে কমতে এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু লিও তা মানবে কেন? সে বেচারি আগের মতোই অবন্তির পিছে ঘুরঘুর করে, সুযোগ পেলে কোলে উঠে বসতে চায়, এককেজি দুধ কেন একপোয়াতে এসে ঠেকল মিউ মিউ করে তার কৈফিয়ত চায়, আগের মতো অবন্তির কম্বলের তলায় ওম চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আর অবন্তি? লিওর মিউ শুনলেই এখন তার কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ে। যা, সর সর, সারাক্ষণ বেহায়ার মতো পিছে ঘুরঘুর করে, কোথাও বসে একটু শান্তি নাই, যা বেরো ঘর থেকে। বলে লিওকে বহু কষ্টে রুম থেকে তাড়িয়ে অবন্তি দরজা লাগিয়ে দেয়। লিও বেচারি মন বেজার করে একা একা এঘর-ওঘর করে। কাজের মাতারি দুটার সামনে সে ভুল করেও পড়তে চায় না, খুব সাবধানে থাকতে হয়, আর পড়ে গেলেই লাত্থি-উষ্টা থেকে তার রেহাই নাই।
লিওর প্রতি এমন অবহেলা দেখানোর পিছনে অবন্তি কতগুলো যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। এক. বিড়ালটা বাথরুম সারতে প্রতিদিন দুবার করে বাইরে যায় (লিওর হাগামোতার কাম ফ্ল্যাটের ভিতরেই সারার জন্য অবন্তি এক বান্ধবির পরামর্শে একটা বিশাল টবে মাটি ভরে বারান্দায় রেখেছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও লিওকে এই সহবত দিতে পারে নি। ওসব কাজ সারতে লিওর নীচেই যাওয়া চাই)।এভাবে নীচে যেতে যেতেই কোথাকার এক নোংরা মর্দবিড়ালের সাথে তার খাতির হয়েছে।প্রায়ই আকাম-কুকাম করে আসে, যা অবন্তি একদমই সহ্য করতে পারে না। দুই. হুটহাট করে আর রাতে তো বটেই লিও অবন্তির বিছানায় উঠে কম্বলের উপরে বা নীচে ঢুকে আয়েশ করে শুয়ে থাকে। আগে অবন্তি ব্যাপারটা খুশিমনে মেনে নিলেও বাইরের বিড়ালটার সাথে মেশার পর থেকে লিওকে বিছনাতে উঠতে দেয় না। বাইরে গিয়ে পা নোংরা করে সেই পা নিয়ে তার বিছানাও নোংরা করবে, অসম্ভব! একারণে লিওকে কোলে তো নেয়-ই না, বরং ওর গায়ে হাত ছোঁয়াতেও তার আর মন টানে না। তিন. খাওয়ার সময় লিও অবন্তির প্রায় গা ঘেঁষে মিউ মিউ করতে থাকলে অবন্তি খেতে পারে না (আগে বিলকুল পারতো)।আগে অবন্তি যাই খেত তার কিছু অংশ লিওকে না দিয়ে , এখন খাওয়ার সময় লিওর চেহারা দেখলেই তার খাওয়ার প্রতি অভক্তি আসে।
শুভ একদিন হাসতে হাসতে অবন্তিকে তার বিড়াল পোষার খেয়াল শেষ হতে চলেছে বলায় অবন্তি লিওর বিরুদ্ধে এইরকম বেশ ক’টি অভিযোগের ফিরিস্তি শুনিয়ে দিয়েছিল। শুনে শুভ মনে মনে হেসেছিল কারণ আসল ব্যাপার হল তার খেয়ালি বউটি বেশিদিন এক জিনিস নিয়ে মজে থাকতে পারে না।
শুভর কথাই অবশেষে সত্যি হয়। এ বাড়ি থেকে লিওর ভাত ওঠে। জমিলাকে একদিন অবন্তি কড়া করে হুকুম দেয় লিওকে বাড়িছাড়া করতে, এই পাড়াবেড়ানো লাফাঙ্গা বিলাই সে আর ঘরে রাখবে না।
জমিলা মহাখুশিতে কোত্থেকে একটা মোটসোটা ডাণ্ডা যোগাড় করল। লিও সকালের পর বাথরুম সারতে নীচে নামলে জমিলা ডাণ্ডা হাতে বারান্দায় এসে বসল। এই বারান্দাই হল লিওর যাওয়া-আসার পথ। অবন্তিরা থাকে দোতলার ফ্ল্যাটে। লিও বারান্দা থেকে লাফ দেয় উঁচু পাঁচিলে, পাঁচিল থেকে মাটিতে। আধঘণ্টা বাদে লিও পাঁচিল হতে লাফিয়ে যখন বারান্দার দেয়ালে উঠল, সামনে বসা জমিলাকে দেখেই সে থমকে গেল, বলা ভাল পিলে চমকে গেল কারণ জমিলার কোমল আচরণ সম্বন্ধে সে খুব ভাল অবগত। এক ঝলকেই লিও বুঝে গেল বারান্দার দরজাটি বন্ধ, এট্টু ফাঁক থাকলে না হয় বিদ্যুৎগতিতে এক লাফে ভিতরে ঢুকে পড়ার রিকস্টা নেয়া যেত। লিওর চোখের মণি নড়ছে দ্রুত। জমিলার চোখে চোখ রেখে আবার নীচে লাফ দেবে কিনা নিয়ে লিও যখন চিন্তিত তখন জমিলা খুব সাবধানে ডাণ্ডাটি হাতের মুঠিতে নেয়। একটা জুতমতো বাড়ি দিয়ে বিলাইটার হাড্ডি ভাঙাই তার ইচ্ছা। তাড়াহুড়া করে সে সুযোগ হারাতে চায় না।
মুহূর্ত মধ্যে ধাম করে দেয়ালে একটা আওয়াজ হয়।
শয়তানডা, পারলাম না। এই ডাণ্ডার বাড়ি তোরে আমি খাওয়ামুই নাইলে আমার নাম জমিলা না।
এই প্রথম লিও পাঁচিল ছাড়া সরাসরি মাটিতে লাফিয়ে পড়ল আর পড়েই হাওয়া।
ঘণ্টা দুই পর।
অবন্তি ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছে। এমন সময় বারান্দার দরজায় কিসের ঘস ঘস শব্দ এবং একটু বাদেই শোনা গেল নীচুস্বরে লিওর কণ্ঠ মিয়াও, মিয়াও। অবন্তির মনটা আনমনা হয়ে গেল। কি করুণ কণ্ঠে বিড়ালটা ডাকছে, যেন তার নাম ধরেই। হ্যা, তাকেই তো ডাকছে, নাইলে সে এসে বসার পরই ডাকতে শুরু করল কেন? নিশ্চয়ই দুপুরে কিছু খেতে পায়নি। আহারে।
বিলাইডায় আইয়া পড়ছে আফা? এইবার ছাড়ন নাই, এমন বাড়ি দিমু এক্কেরে বাপের নাম ভুইল্লা যাইবো।
অবন্তি তাকিয়ে দেখে সামনে জমিলা ডাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে। বারান্দার দরজার দিকে জমিলা এগোতেই অবন্তি হুঙ্কার দিল, খবরদার, লিওর গায়ে একটা বাড়িও দেবে না। তুমি যাও এখান থেকে। সালেহাকে বলো লিওর জন্য দুধ নিয়ে আসতে।
পুরোনো আস্তানায় সহি সালামতে ফিরে এল লিও। আর অবন্তি অ্যালবাম বের করে লিওর সাথে তোলা ছবিগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল। এতদিন লিওর সাথে তার কত সুন্দর সব মুহূর্ত কেটেছে আর আজ সে এত পাষাণ হতে পারে কীভাবে? না না, লিওকে সে খেদাতে পারবে না, আদর-যত্ন না হয় নাই করল কিন্তু গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করতে পারবে না।

দুই.
দশ বছরের লেবু মিয়াকে নিয়ে আম্বিয়া আর পারে না, প্রতিটা দিনই পোলাটার কাম দেখে রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলতে থাকে তখন পাগলের মতো সে চিল্লাতে থাকে, হারামির বাচ্চা তুই নিজে পাছ না খাইতে আবার কুত্তার ছাওডারে খাওয়াছ? ফুটপাথে থাইকা এমন জমিদারি স্বভাব পাইলি কোহান থেকা? আরে ফকিরনির পুত তোর বাপ যে আরেক মাগিরে লইয়া ভাইগা গেছে, তোর মায় তোরে ভিক্ষা কইরা আইনা খাওয়ায়, এইডা মনে থাকে না?…
এসব কথা লেবু মিয়ার এক কানের ফুটা দিয়ে ঢুকে আরেক কানের ফুটা দিয়ে বেরিয়ে যায়; সুতরাং মাথায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আজকে দুপুরে তাদের মায়ে-পোয়ের খাওয়া হিসেবে জুটেছে তিন টাকা দামের একটি করে পাউরুটি। লেবু মিয়া নিজের ভাগের পাউরুটিটা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কালু আর সাদুকেও ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। কুকুর ছানাটা কালো বলে লেবু এটার নাম রেখেছে কালু আর বিড়ালটা সাদা বলে সাদু। কালুটাকে এক্কেবারে পিচ্চি বয়স থেকে তিনমাস হলো পালছে লেবু, সাদুটাকে পরশুদিন থেকে।
সাদুর বাচ্চা, তুই তো বহুত হারামি, কালুর খাওন খাছ কিল্লেগা? হালার পুত, কালু তো তোর চেয়া বড়ো, কই তোর খাওন তো থাপা দেয় না। হালা, নেতা হইয়া গেছো, না? সাদুকে হাল্কা একটা কানপট্টি দিয়ে লেবু শেষ রুটির টুকরাটা কালুকে দেয়।

শুভ-অবন্তি দশদিনের জন্য ইন্ডিয়া গেছে। যাওয়ার আগে জমিলাকে বলে গেছে লিওকে এবার বের করে দিও, তবে মারধোরের দরকার নাই, বারন্দাটা ভালমতো বন্ধ রাখবে যাতে ঢুকতে না পারে। কিন্তু জমিলা তো জমিলা, সে দুই দিন লিওকে ‘দেখিবামাত্র’ এমন ডাণ্ডা চালায় যে ও বেচারি তৃতীয় দিন আর বাড়িতে ঢুকতে এক ছটাক সাহস পায়নি।
অবন্তিদের এপার্টমেন্টের উল্টো পাশের রাস্তার ফুটপাতে আম্বিয়ার চার হাত বাই আড়াই হাতের খুপরিটা। লেবু মিয়ার সহজ আপ্যায়ন জুটে গেল লিওর ভাগ্যে। আর বোবা প্রাণীরাও অতি তাড়াতাড়ি বুঝে যায় কে তার শুভাকাঙ্খী। দুদিন লেবু মিয়ার লগে লগে রইল। আর যাবেই বা কোথায়? তৃতীয় দিন লেবু মিয়া কালুর মতো লিওকেও তার বন্ধু করে নিল।
রাস্তার পাশের এই খোলা জায়গার খুপরিতে লিওর সবই সয়ে এলো কেবল ভাল খাওয়ার কষ্টটা ছাড়া। কিন্তু কী আর করা? বেশি খিদা পেলে খুপরির পাশে বসে শূন্য ঘোলা দৃষ্টিতে উল্টো পাশের দোতলার বারান্দাটার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে। যেখানে অবন্তি নাই আছে শুধু জমিলা আর তার বেরহম ডাণ্ডা।

দশদিনের জায়গায় পনের দিনের দিন রাতে শুভ-অবন্তি ইন্ডিয়া ভ্রমণ শেষে ফিরে এল।


তিন.
অবন্তির ঘুম ভাঙল দুপুর বারোটায়। কাল রাতে বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে সেই যে মরাঘুম দিয়েছে, শুভ কখন উঠে অফিস চলে গেছে টেরও পায়নি। বেশ একটা মোচড়া-মোচড়ি দিয়ে বিছনা থেকে নেমে দাঁড়াল সে। আর তখনই চোখ পড়ল ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফটো স্ট্যান্ডটাতে। লিওকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে সেখানে বসে আছে অবন্তি। আচ্ছা লিওটা এখন কোথায়? তার কথামত জমিলা নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দিয়েছে। যাক আপদ গেছে। ফটো স্ট্যান্ডের ছবিটা পাল্টে অন্য কোন ছবি রাখতে হবে, ভাবতে ভাবতে বাথরুমে ঢুকে যায় অবন্তি। কিন্তু বিকালে বারান্দায় বসে দার্জিলিং থেকে আনা চায়ে দুটা চুমুক দিয়ে রাস্তার ওপাশের খুপরিটার দিকে তাকিয়ে যে দৃশ্যটা অবন্তি দেখে তাতে তার ভুরু কুঁচকে যায়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বকের মতো মুখটা সামনে বাড়িয়ে দৃশ্যটা সে ভালমত খেয়াল করে। একটা নয়-দশ বছরের ছেলে কোলে বিড়াল নিয়ে খেলা করছে। একটু পর পর বিড়ালটাকে পাশের দড়ি বাধাঁ কুকুর ছানাটার পিঠে ছেড়ে দিয়ে হে-হে করে হেসে উঠছে। না, অবন্তির চোখ ভুল করার কথা না, পিচ্চিটা যে বিড়াল নিয়ে খেলছে সেটা লিও। এই কয়দিনে খুব শুকিয়ে আর গায়ের রঙটা ময়লা হয়ে গেলেও চেনা যায়। লেজের শেষটায় হালকা বাদামি রং, ডান পায়ের নীচের দিকেও তেমনি, এ-তো লিও না হয়ে যায় না। অবন্তির ভিতরটা হঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল কারণ পিচ্চিটা এখন লিওকে বুকে চেপে ধরে আদর করছে, ঠিক যেভাবে সে এক সময় আদর করত! অবন্তি সাথে সাথে ডেকে উঠল, জমিলা! জমিলা!
জমিলা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইল না। না আফা, হইতেই পারে না। বিলাইডারে এমন মাইর দিছি, অয় তো এই এলাকা ছাইড়াই গেছে গা।
থামো, গেলে ওটা কি আকাশ থেকে এসেছে? আমার বাড়ির সামনে আমার পালা-বিড়াল নিয়ে ফকিরনির ছেলে আদর-সোহাগ করবে এটা সহ্য করা যায়?
সহ্য যে করা যায় না সেটা বোঝা গেল এরপর থেকে অবন্তির নাই কারণে অসংখ্যবার বারান্দায় চলে যাওয়া দেখে। চোখটাকে সে আতশ কাচ বানিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলে লিওর সাথে ফকিরনির ছেলেটার মাখামাখি। দেখতে দেখতে অবন্তির চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। ডান হাত কচলাতে শুরু করে। না, কিছুতেই সহ্য করা যায় না। তার ফেলে দেয়া জিনিস তার সামনে আরেকজন মাথায় তুলে নাচবে, এ অপমান সে সহ্য করে কীভাবে? ফকিরনির ছেলেটার কোলে লিওকে দেখলেই মনে হয় ওরা দুইজন তাকে তামাশা করছে, বলছে, তোমরা দালানের লোকরা সব নিষ্ঠুর, এইখানে এই খুপরি ঘরে আমরা দুই দোস্তে দারুণ আছি, এইখানকার মানুষেরা তোমার মতো ছোটলোক না।
অবন্তি ভয়ানক ক্ষেপে গেল। জমিলাকে সে পাঠিয়েছিল লিওটাকে ফেরত আনতে, ফকিরনির ছেলেটা দিল না, এমনকি টাকা সাধার পরেও না। অবন্তির জিদ চেপে যায়। যেভাবেই হোক লিওকে ঐ ফকিরনির ছেলেটার কাছ থেকে সে সরাবেই।
বুদ্ধি খুলতে দেরী হয় না। পরদিনই অবন্তি দোকানে গিয়ে ইঁদুর মারা বিষ কিনে আনে। তারপর পরীক্ষার হলে এমাথা থেকে ওমাথা গার্ড দেয়া স্যারদের মতো কেবল ঘর-বারন্দা বারান্দা-ঘর করতে লাগল। তক্কে তক্কে থাকল কখন ফকিরনির বাচ্চাটা খুপরি ছেড়ে বাইরে যায়। দুপুরের দিকে সুযোগটা এসে গেল। খুপরির বাইরে তখন কেবল কুকুরটা আর লিও। অবন্তি দৌড়ে গেল ডাইনিংরুমে। কয়েক পিস পাউরুটির সাথে মেশাল বিষ, সবশেষে একটু গুড়ো দুধের প্রলেপ।
বারান্দা থেকে রাস্তার ওপাশের খুপরিটা বিশ-পচিশ গজ দূরে। অবন্তি প্রথমে একটা পিস ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে। কাজ হলো। লিও খাওয়া দেখতে পেয়েই ক্ষুধার্তের মতো দৌড়ে আসে। কিন্তু খেতে গিয়ে একটু শুকে কী মনে করে উপর দিকে তাকাল। অবন্তিকে দেখে কেমন যেন দ্বিধা করল। তবে খাওয়া শুরু করতে দেরি হলো না। দুধের ছোঁয়া দেয়া রুটি গপাগপ গিলতে থাকে লিও। উল্লসিত অবন্তি এক পিস এক পিস করে দ্রুত পাঁচটা পিস ছুড়ে মারে। এ লোভনীয় দৃশ্য দেখে খুপরির পাশে বাধা কুকুরটা রসি ছিড়ে রাস্তার এপারে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করে আর চিকন গলায় অসহায়ের মতো কেউ কেউ করতে থাকে।
লিওর খাওয়া শেষ হলে অবন্তি তার হিটলারী সফলতায় গর্বিত হয়ে ঘরের ভিতর চলে আসে।
ঘণ্টা দেড়েক বাদে ড্রইংরুমে বসে দার্জিলিং-চা খেতে খেতে অবন্তি একটা মিহি কান্নার শব্দ শুনতে পায়। মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে চলে যায় বারান্দায়। খুপরিটার দিকে চেয়ে অবন্তি স্পষ্ট দেখতে পায় লিওর নিথর দেহটি। ফকিরনির ছেলেটা সে মরদেহ কোলে নিয়ে করুণ স্বরে কাঁদছে, আমার বন্ধুরে..।
দৃশ্যটা দেখে অবন্তির চোখ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে, আমোদে মনে মনে হাত তালি বাজায়। বিড়বিড় করে ছেলেটার উদ্দেশে বলে, দ্যাখ ফকিরনির বাচ্চা, আমি যা চাই করি, আমি কখনো হারি না।

মে-অ-ও, মে-অ-ও..।
বেশ রাত। অবন্তি শক্ত করে শুভকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরেছে। অনেকক্ষণ হলো শুয়েছে তারা। শুভ ঘুমিয়ে পড়লেও অবন্তির ঘুম আসছে না। যদিও বালিশঘুম তার, বিছানায় মাথা ছোঁয়ালেই হয়। কিন্তু আজকে সে চোখ বুজতেই পারছে না। চোখ বন্ধ করলেই দেখে এক জোড়া হলুদ জ্বলজ্বলে চোখ তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে। শুধু তাই নয়, আস্তে আস্তে হলুদ চোখের প্রাণী গরগর করে মৃদু আওয়াজ তোলে, মে-অ-ও, মে-অ-ও..।অবন্তি ভয় পেয়ে দ্রুত চোখ খুলে ফেলে। শুভকে জোরে আঁকড়ে ধরে।প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে এই চলছে। এর মধ্যে দুইবার শুভর ঘুম ভেঙেছে। তার ঘুম আবার পাতলা। এবার তিনবারের মতো ভাঙলে শুভর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অবন্তির হাত-পা-শরীর নিজের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
উহ, এতো জোরে চেপে ধরছো মনে হচ্ছে মেরেই ফেলবে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বাবা। তোমার হয়েছেটা কী বলোতো?
অবন্তি গত দুবার কথাটা বলেনি, এবার সাহস করে জিজ্ঞেস করল, একটা বিড়াল ডাকছে, তুমি শুনতে পাচ্ছ?
কে ডাকছে? হতভম্ব শুভ ঘুমজড়ানো ভাঙা-গলায় ভয়ানকভাবে চোখ কুঁচকে তাকায়, বিড়াল? কই নাতো।
শুভ সন্দেহ-চোখে অবন্তির মুখ পড়তে চেষ্টা করে, তোমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে? এই মাঝরাতে বিলাই ডাকবে কেন? আর ডাকলে ডাকবে, রাস্তাঘাটে বিলাই-কুত্তার তো অভাব নাই। তোমার ঘুম তুমি ঘুমাও। যত্তসব! ঘুমাও। ধমকে শুভ ডানহাতে অবন্তিকে জড়িয়ে চোখ বোজে।
অবন্তি শান্ত ছোট্ট মেয়ের মতো মাথাটা শুভর কাঁধ ঘেঁষে বাম হাতে তাকে ভালমতো আঁকড়ে ধরে। চোখ বুজে ঘুমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু খানিক বাদেই চোখের মধ্যে জ্বলে ওঠে সেই জোড়া হলুদ চোখ। ভয়ে চোখ খুলে ফেলে। সেই সাথে অবন্তি পেটে একটা ভীষণ চাপ অনুভব করে। বুঝতে পারছে নিম্নচাপ সারতে এখন তার বাথরুমে যাওয়া দরকার। তবে একা একা বাথরুমে সে কিছুতেই যেতে পারবে না।
মে-অ-ও, মে-অ-ও..।
একি? বাথরুম থেকে ডাকটা আসছে না? ওটা কি এখন বাথরুমে এসে বসে আছে? হায় আল্লা! অবন্তির শরীরটা ভয়ানক কেঁপে ওঠে, শুভকে প্রচণ্ড জোরে আঁকড়ে ধরে সে।


ফাল্গুন ১৪১৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *