গল্প, বাংলা

কথার ব্যবসায়ী

কম্পিউটারে একটা থ্রি-এক্স ছেড়ে বিছনায় এসে বসে মিরাজ। বলে, দ্যাখ, নতুন জিনিস আনছি, মজা পাবি দেইখা।

মিরাজের ঘরে এসি লাগানোর পর আজকে প্রথম এসেছে সাদমান। এসির হিম বাতাসে পাঁচ মিনিট থেকেই শরীর ঠাণ্ডা হওয়ার পর এখন গায়ে কাঁথা-জড়ানো শীত লাগছে। এসি লাগানো উপলক্ষে ঘরটার চেহারা-সুরতও আচানক পাল্টে গেছে। ফ্লোরে দামি কার্পেট, দেয়ালে পড়েছে ডিসটেম্পার, আর লাখখানিক টাকা দামের কম্পিউটার তো আগেই ছিলো।
তোগো এইসব বড়লোকি কাণ্ডকারখানা দেইখা আমগো মজা বাইরায় …অই জাগা দিয়া, শালা! কথাটা সাদমান মনে মনেই রেখে দ্যায়। মুখে অস্বস্তির প্রলেপ থিরথিরিয়ে কাঁপলেও চোখ রাখে মনিটরের ওপর। বড়লোকের ছাওয়াল তো, এইসব ছাড়া চলে না। বিএ ভর্তি হইতে না হইতেই রহস্যে ভরা প্রাচীন পৃথিবীর মতোই সেক্স নামক আদিম বিষয়টা এখন ওর কাছে ডাল-ভাত। বাসার কিশোরি কাজের মেয়েদের পটাতেও বাছাধন একেবারে সিদ্ধহস্ত।
তুই শটকাটে লাখপতি হইতে চাস? হঠাৎ মনিটর থেকে মুখ ঘুরিয়ে সাদমানের কাঁধে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে মিরাজ জিজ্ঞেস করে।
মিরাজের প্রশ্ন শুনে সাদমান ঠোঁেটর কোণে অলস হাসির রেখা তৈরি করে, বড়লোক হইতে কে না চায়!
একদম ঠিক!
মিরাজের মুখ থেকে বিজিএন-র কথা জানতে পারে সাদমান। কী এক কানাডিয়ান কোম্পানি, খালি দুই-তিনজন ঢুকাইতে হয়, তারপর সপ্তায় সপ্তায় টাকা। এ ব্যবসা করছে এমন একজনের মোবাইল নম্বরও দিয়ে দ্যায় তাকে। যাওয়ার সময় সাদমান আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে, আচ্ছা তুই এ ব্যবসা শুরু করছ না ক্যা?
আমি? আমি এহন ব্যবসা কইরা কী করমু? টাকার কি অভাব পড়ছে নাকি!
শালা কইলেই পারো তোমার বাপে রাজি হইবো না। মনে মনে গজরায় সাদমান। ব্যাংকের থেকা ১৫ বছর আগে যে লোন নিয়া তোমার বাপ পাঁচতালা বাড়িটা বানাইছে ওই লোনই তো শোধ করে নাই। মিরাজের মতে সরকারি ব্যাংকের এইসব লোন নাকি শোধ দেওয়া লাগে না, ওপর থেকা কালেভদ্রে চাপ আসলে দান-খয়রাতের মতো তখন কিছু ঘুষ ছিটাইয়া দিলেই সব চুপ হইয়া যায়।

মিরাজের বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাদমানের মনে হলো, এই পড়ন্ত বিকেলে একবার সাথির বাসায় ঢুঁ মারবে কিনা। কিন্তু যাওয়া কি ঠিক হবে? এই সপ্তায় তো একবার গিয়েছে। বেশি বেশি গেলে আন্টি যদি আবার সন্দেহ করে! গেলে অবশ্য চিঠির উত্তরটা পাওয়া যেতো। সাথির মা-ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে ইদানীং চিঠি চালাচালির ভালো একটা উপায় বাতলানো গেছে। মাধ্যমটা গল্পের বই দেওয়া-নেওয়া। বইয়ের একেবারে শেষ পৃষ্ঠাটা হালকা আঠায় আটকে তার ভিতরে চিঠিটা ঢুকিয়ে দেয়।
সবাই জানে সাদমান আর সাথি বন্ধু। বছর পাঁচেক আগে যখন সাদমান ও সাথিরা একই বাড়িওয়ালার বাসায় ভাড়া থাকতো তখন সম্পর্কটা বন্ধুত্বেরই ছিলো। সাথিদের আর্থিক অবস্থার বেসম্ভব উন্নতি ঘটতে থাকলে ওরা এলাকার ভিতরেই একটি বড়ো ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠে যায়। মুশকিলে পড়ে যায় সাদমান কারণ তখন উপলব্ধি করে তাদের অজান্তেই দুজনের সম্পর্কটা ততদিনে অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের ব্যাপারটা কেউ না জানলেও সাদমান খুব ভয়ে থাকে। যদি কখনো জেনে ফেলে! তাহলে তো সাথির সাথে তার দেখা হওয়া লাটে উঠবে। আবার একটি ব্যাপারে সাদমান ক্রমে উদ্বিগ্ন হচ্ছে। সাথির বাবার ব্যবসা যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠছে, আর্থিক উন্নতি বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে তো? সাথির বিয়ে হতে এখনো তিন-চার বছর। এর মধ্যে আর্থিকভাবে তাকে একটা ভালো অবস্থানে আসতে হবে। এর জন্য এখন থেকেই তোড়জোর। পড়াশুনার পাশাপাশি ছোটোখাটো ব্যবসাপাতি শুরু করতে হবে। ব্যবসা ছাড়া যে বড়লোক হওয়া যায় না, সেটা তো তার চোখের সামনেই দেখতে পেলো। সাদমানের বাবা সরকারী চাকুরে আর সাথির বাবা ব্যবসায়ী। একই বাড়িওয়ালার বাসায় যখন ভাড়া থাকতো তখন সাথিদের অবস্থ্া বলা যায় তাদের চেয়েও খারাপ ছিলো আর এখন ওরা কোথায় চলে গেছে! সুতরাং বড়লোক হতে হলে ব্যবসা করতে হবে এবং সেটা এখনই শুরু করতে হবে। সাথিকে যে তার পেতেই হবে।

দুই.
ফোন করে পরদিনই সাদমান নতুন দেশ আবিষ্কারের উত্তেজনা নিয়ে চলে যায় গুলশানের বিজিএন অফিসে। লিফটে চড়ে সাত তলার অফিসে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। ভেতরে এলাহি কাণ্ড। ফ্লোরে চকচকে টাইলস আর সিলিং-এ ফিট করা দুর্বাঘাসের মতো অসংখ্য আলোর প্রতিফলন তাতে; ঢোকার মুখেই অনিন্দ্য সুন্দরী রিসিপশনিস্ট, খুচরো পয়সার মতো অকাতরে সবাইকে বিলানো তার হাসির ধরণ দেখে মনে হয় একটু চেষ্টা করলেই ভাব জমানো সম্ভব। মাঝখানে একটি বড় ও চারপাশে কয়েকটি ছোট রুম। সবগুলোতেই ঢোকার মুখে কাচের দরজা। লেবুর সুগন্ধিযুক্ত রুম-স্প্রে ছড়ানো বাতাস নাকে ঢুকে যে কাউকে এখানকার আবহাওয়ায় সম্মোহিত করে ফেলবে। শালা, এর জন্যই গুলশান-বনানীরে কয় বড়লোকি পাড়া!
মোবাইলে আলাপ হওয়া মাহমুদ নামের একজন সাদমানের অপেক্ষায় বসে ছিলো। যদিও কেউ কাউকে চেনে না, কিন্তু সাদমানের অনুসন্ধানী চোখ দেখে ২৫-২৬ বছরের এক যুবক এগিয়ে এলো। আপনি তো সাদমান, না?
জি।
আমি মাহমুদ। বলে সাদমানের দিকে হাত বাড়িয়ে দ্যায়। একবারে ঠিক সময় আসছেন, এখনই নতুন সেমিনার শুরু হবে।
হাত না ছেড়েই মাহমুদ তাকে হাল্কা টেনে পাশের বড় রুমটাতে নিয়ে আসে। আলোকোজ্জ্বল রুমটাতে সার দিয়ে চেয়ার রাখা। জনা পঞ্চাশেক বসার ব্যবস্থা। কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবগুলোই ভর্তি। এদের মধ্যে আট-দশজন মহিলাও আছেন। একেবারে সামনের সারির একটা সিটে ব্যাগ রাখা ছিলো, মাহমুদ সেটি হাতে নিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়ে সহাস্যে আশ্বস্ত করে, এখনই শুরু হয়ে যাবে, সেমিনারটা দেখে নেন, তারপর সব কথা হবে, আমি বাইরে অপেক্ষা করতেছি।
মাহমুদ চলে গেলে সমাদমান ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকায়। ক্লাসরুমের মতো একেবারে সামনে একটি হোয়াইট বোর্ড। রুমটা খুব ঝকঝকে তকতকে। সবাই নিচুস্বরে কথাবার্তা বলছিলো। সাদমানের মনে হলো সবার কথা বলার বিষয়বস্তু একই।
একটু পরেই সাদা শার্টের ওপর টাই পরা মধ্যবয়সী এক লোক ঘরে ঢুকে সবার সামনে চলে আসে। দেয়ালে ঝুলানো হোয়াইট বোর্ডের সামনে রাখা স্টিক হাতে দাঁড়িয়ে সকলের ওপর সেনা অফিসারের দৃষ্টি ফ্যালে। গুঞ্জন হঠাৎ প্রায় থেমে যায়। লোকটি গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করে, অ্যাটেনশন প্লিজ। আমি সালাউদ্দিন জমাদার। সেমিনার শুরু করছি। কথা বলার মাঝখানে কেউ প্রশ্ন করবেন না। কথা শেষ হলে আমি নিজেই আপনাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেবো।
তারপর পান খাওয়া রঙিন দাঁতের সালাউদ্দিন জমাদার মুখে আর বোর্ডে লিখে যা বুঝালো তার সারসংক্ষেপ হলো : নেটওয়ার্ক মার্কেটিং আমাদের দেশে নতুন হলেও বিশ্বে এটি নতুন নয়। একটা পণ্য উৎপাদনের পর ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে গতানুগতিক পদ্ধতিতে কী করা হয়? উৎপাদনকারী- এজেন্ট-পাইকার-খুচরা-ভোক্তা। কিন্তু নেটওয়ার্ক পদ্ধতিতে হলো উৎপাদনকারী-নেটওয়ার্ক-কোম্পানি-ভোক্তা। এতে পণ্যের বিজ্ঞাপন খরচ, শোরুমসহ অন্যান্য খরচ ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের প্রয়োজন হয় না, অতএব এই খাতে যে খরচটা হতো তা পাচ্ছে নেটওয়ার্ক কোম্পানি ও কর্মীদল। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি ১৯৪০-৪১ সালে প্রথম প্রবর্তন করেন আমেরিকান ফুড-কেমিস্ট ড. কার্ল রেইন বোর্গ। ১৯৫৮ সালে আমেরিকান পার্লামেন্টে এই পদ্ধতি ১০ ভোটের ব্যবধানে অনুমোদন লাভ করে। সারাবিশ্বে ১২৫টিরও বেশি দেশে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর সূচনা হয় ১৯৭২ সালে, হাঙ্গেরিতে ১৯৯২ ও জাপানে ১৯৯৩ সালে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। সেই হিসাবে আমারা ভাগ্যবান কারণ ভারত থেকে আমরা ৫০ বছর পিছিয়ে থাকলেও মাত্র ২ বছরের মধ্যে এই ১৯৯৯ সালেই বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং চলে আসছে।
বিজিএন-এ ঢুকতে হলে প্রথমে ৭,৫০০টাকা দিয়ে একটা পণ্য কিনতে হবে। এ কোম্পানির কয়েক ধরনের পণ্য আছে, যার যেটা দরকার সে মতো কিনলেই এখানকার মেম্বার হওয়া যায়। তারপর আরো দুজন যোগাড় করে পণ্য কিনাতে হবে। তাহলে ফাস্ট লেভেল ফিলআপ হয়ে গেলো, সাথে সাথে পাওয়া যাবে ১,৫০০টাকা। পরে নিচের দুজন যখন আরো চারজনকে তাদের আন্ডারে ঢুকাবে তখন সেকেন্ড লেভেলে পাওয়া যাবে ৩,০০০, থার্ড লেভেল সম্পন্ন হলে ৪,৫০০টাকা। এইভাবে নিচের হ্যান্ডরা যত কাজ করবে, উপরের জন বসে বসে তার কমিশন পেতে থাকবে।

সেমিনার শেষ হলে মাহমুদ এসে সাদমানকে নিয়ে বের হতে হতে জানতে চায়, কী, মনের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন খুত খুত করছে?
সালাউদ্দিন জমাদারের কথাগুলো সাদমানের মনের মধ্যে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনাও কাজ করছে, কিন্তু ব্যাপারটা কেমন ধোয়াশা লাগছে। মাহমুদের প্রশ্নটা শুনে সাদমান অল্প হেসে সায় দেয়, হ্যাঁ, বিষয়টা পুরাপুরি ক্লিয়ার না।
সব বুঝবেন কোনো অসুবিধা নাই।
সেমিনার রুমের বাইরে ডানদিকে খানিকটা জায়গা, সেখানে ছোটো ছোটো বেশ কটি টেবিল এবং প্রায় প্রতিটি টেবিলই এক-দুইজন দখল করে আছে। সেমিনার-ভাঙা লোকজন অনেকেই তাদের মতো সেদিকে যাচ্ছে। একটি টেবিলের সামনে এসে রিভলভিং চেয়ারে বসে থাকা লোকটিকে মাহমুদ বলে, প্রকাশদা, এই আমার গেস্ট সাদমান, ওনাকে ফিনিশিং-টা দিয়ে দ্যান।
সাথে সাথে প্রকাশ উঠে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ছড়িয়ে সাদমানের দিকে হাত বাড়িয়ে দ্যায়। সাদমানও হাত বাড়িয়ে পরিচিতি পর্ব সারে। সাদমান আশেপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলো ইতোমধ্যেই তার মতো সেমিনার-ফেরত মানুষ দুই-তিনজন করে কারো না কারো টেবিলে বসে পড়েছে এবং কাগজের ওপর কী সব আঁকিবুকিঁর ওপর গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করছে। এই টেবিলে সে-ই কেবল একা।
তারপর সাদমান সাহেব, কেমন লাগলো সেমিনার? প্রকাশদা হাসিমুখে জানতে চায়।
ভালো, তবে কিছু প্রশ্ন আছে।
প্রশ্ন তো থাকবেই আর তার জন্য তো এ অধম আছেই।
এরপর প্রকাশদা কাগজ-কলম নিয়ে আঁকিবুকিঁ শুরু করে একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাদমানের যাবতীয় জিজ্ঞাসা-কৌতূহল-অস্পষ্টতা মিটিয়ে দিতে লাগলা : বিজিএন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হতে নিবন্ধনকৃত, সরকারি দলের দুইজন মন্ত্রিরও এতে শেয়ার আছে, অতএব ভূয়ামি করার সুযোগ নাই। আর নেটওয়ার্ক ব্যবসা তো পশ্চিমা দেশগুলাতে ব্যাপক জনপ্রিয়, আপনি ইন্টারেনেটে একটু খোঁজখবর নিলেই জানতে পারবেন। বসে বসে এতো টাকা কীভাবে পাবেন? আরে এটা তো হলো কমিশন। ধরেন, আপনি দোকান থেকে একটা টিভি কিনবেন দশহাজার টাকায়, সেই একই টিভি যদি আমাদের এখান থেকে কিনেন, তাহলে সেটার দাম পড়বে অনেক কম। কারণ কি? কারণ ওদের বিজ্ঞাপন খরচ আছে, আমাদের নাই। আপনি একটি পণ্য কিনে এখানে মেম্বার হয়ে আরো দুজনকে যখন সেই পণ্য কিনাবেন তখন আপনি সেই বিজ্ঞাপন খরচের কমিশনটা পাবেন। এই কমিশন কিন্তু শুধু আপনি না, আপনার ইমিডিয়েট ওপরে যে আছে সে পাবে, তার ওপরে যে আছে সে পাবে, তার ওপরে। এইভাবে অনেক দূর। একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত পাবে। আপনি একজন যোগাড় না করতে পারলে কী হবে? ধরলাম, আপনি রাইট হ্যান্ডে একজন ঢুকালেন কিন্তু লেফট্ হ্যান্ডে কাউকে ঢুকাতে পারলেন না, তাতে কি হলো? আপনার লেভেল ওয়ান পূর্ণ হলো না আর আপনি টাকাও পাবেন না, তাই তো? সেই ক্ষেত্রে আপনি যদি একেবারেই আরেকজন ঢুকাতে ব্যর্থ হন তাহলে আপনার ওপরে যারা আছে তারাই আপনার আন্ডারে একজনকে দিয়ে দেবে। কারণ, এই একজনের জন্য যেমন আপনার ফাস্ট লেভেল পূর্ণ হচ্ছে না, আপনার ওপরের জনের তেমনি সেকেন্ড লেভেল, তার ওপরের থার্ড লেভেল। এইভাবে সবারটা আটকে যায়। তাদের স্বার্থেই তারা আপনাকে সাহায্য করবে। এইবার বুঝলেন তো? এটা আসলে একটা টিম ওয়ার্ক।
কথা শেষ করে প্রকাশদা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে পিঠটা চেয়ারে হেলিয়ে দ্যায়।

তিন.
সাদমান মাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো, আরে মা, তুমি বুঝতে পারতাছো না, এটাতে কোনো রিস্ক নাই। খালি দুইজন ঢুকাইয়া দিলেই হইলো। তারপর বইসা বইসা টাকা পাওয়া যাইবো।
মা তরকারি কুটতে কুটতে মাথা না তুলেই উত্তর করে, হো! ওগো আর খাইয়া-দাইয়া কাম নাই, তোরে বসাইয়া বসাইয়া টাকা দিবো!
আহা, তোমার মাথায় তো দেহি কিছুই ঢোকে না। শোনো, এই ব্যবসা লন্ডন আমেরিকাতে অনেক আগেই চালু হইছে, আমগো দেশে নতুন দেইখা মানুষ বোঝে না। আর তোমার বুইঝা কাম নাই, তুমি এখন সাড়ে সাতহাজার টাকা আমারে ধার নিয়া দেও।
আমি কারতে ধার নিমু?
কেন ফুফুরতে নিয়া দেও। কইলাম তো দুইমাসের মধ্যেই টাকা শোধ দিমু। সাথে একটা টিভিও উপহার দিয়া দিমু, কই-ও।

সেমিনার করে আসার তিনদিন পর সাদমান আবার বিজিএন অফিসে ঢুকলো। ক্যাশ কাউন্টারে সাড়ে সাত হাজার টাকা জমা দিয়ে ঠোঁটের ফাঁক গলে তার হাসি চুইয়ে এলো। এই অফিসের এখন একজন গর্বিত মেম্বার সে। মেম্বার হওয়ার পর অনেকের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। অফিসটা তখন একটু একটু করে তার নিজের মনে হতে লাগলো। মানুষকে সেমিনার দেখতে ইনভাইট করে সাদমান এখন বলতে পারবে, অফিসে আইসেন। সে যার নিচে ঢুকেছে তার নাম বিকাশ। তার রাইট হ্যান্ড সে, বিকাশের ওপরে আছে আরেকজন, তার ওপরে হচ্ছে মাহমুদ, মাহমুদেরও দুই লেভেল ওপরে হলো প্রকাশদা, আর একদম উপরে যে লোকটি বসে আছে অর্থাৎ তাদের গ্রপ লিডারের নাম হচ্ছে মুকুল। সে হিসেবে তারা হলো মুকুল গ্রপ।
প্রকাশদা সাদমানকে সেদিনই দুই ঘণ্টার একটা শর্ট কোর্স দিয়ে দিলো। তাতে বিজিএন সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য, কীভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হবে, মানুষকে অফিসে এসে সেমিনার দেখতে বলার অ্যাপ্রোচটা কেমন হবে, নেটওয়ার্কিং কোম্পানি নিয়ে লোকে উল্টাপাল্টা কথা বললে রেগে যাওয়া চলবে না, ধৈর্য ধরে বুঝাতে হবে, কারো সাথে কথোপকথনের সময় কথা বলতে হবে এমনভাবে যাতে না-বোধক উত্তরটিকেও হ্যাঁ-বোধক বলানো যায়। সবশেষে প্রকাশদা সাদমানকে একটা দারুন কথা বলে ফেললো, বলেনতো সাদমান সাহেব, এখন দুনিয়াটা চলছে কীসের ওপরে? হে হে, পারলেন না? মুখের জোরে। কথার জোরে, অশ্লীল করে বললে বলতে হয় চাপার জোরে। কথা দিয়া যে কাউকে ইমপ্রেসড্ করা যায়, তবে হ্যাঁ, সে গুণটা অর্জন করতে হবে। যার টাকা-পয়সা নাই জীবনে ওপরে ওঠার তার সবচে বড়ো মূলধন কি জানেন? মুখ, এর আরেক নাম মানুষ বলে তেল। চলতে-ফিরতে-ঘুরতে। যেকোনো কাজে এইটাকে যে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারে, কাজ শুরুর আগেই তার কাজ হাফ-ডান হয়ে যায়। বুঝলেন, সাদমানের পিঠে আলতো চাপড় মেরে প্রকাশদা বলতে থাকে, সফল হওয়ার আপনারে একটা দারুন টেকনিক শিখায়া দিলাম, এটার দাম লাখ টাকা। এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে চাইলে কিছু পড়াশুনাও করতে পারেন।
ডিগ্রি? সাদমান অবাক হয়ে বলে ওঠে।
হ্যাঁ, ডিগ্রি। সবার আগে পড়বেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈল প্রবন্ধটা, তারপর ডেল কার্নেগি, এরপর আরো পড়তে চাইলে বই অনেক আছে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আমাদের কাজটাকে যদি ব্যবসা ধরা যায়, তাহলে সাদা কথায় বলতে হবে আমাদের হচ্ছে কথার ব্যবসা।

চার.
সাদমান জোরকণ্ঠে বলে ওঠে, আরে ব্যাটা শোন, এর মতো সহজ ব্যবসা আর আছে বাংলাদেশে? কোনো কামই নাই, খালি নিজে ঢুইকা আর দুইজন ঢুকাইয়া দিয়া সারাজীবন বইসা বইসা খাও।
কছ কি? তুই তো শালা তাইলে কয়েকদিনেই বড়োলোক হইয়া যাবি। মাসুদ বলে।
হা হা হা। মাসুদের কথা শুনে শংকর হেসে ওঠে।
শোন, শংকর হাসির রাশ টেনে ধরে সাদমানকে বলে, তোর এই যে বিজিএন না ফিজিএন নেটওয়ার্কিং ব্যবসা, তুই এইটারে ব্যবসা কছ কোন হিসাবে আমি তো এইটাই বুঝতাছি না। এটা তো উৎপাদনমুখী কিছু না। ধর, একসময় দেখা গেল বাংলাদেশের সব মানুষ তোদের বিজিএনের সদস্য হইয়া গেল, তখন তোগো ব্যবসায় নতুন সদস্যই তোরা কই পাবি আর বসাইয়া বসাইয়াই বা খাওয়াবি কেমনে, হু?
আরে ভাই, এখানে তো পণ্য বিক্রি করতাছে, পণ্যের চাহিদা তো মানুষের শেষ হইবো না। সাদমান শংকরকে বুঝাতে চেষ্টা করে।
দ্যাখ, আমারে ভোদাই পাইছস? মনে করছস ভুং ভাং দিয়া বুঝায়া দিবি? আরে বাবা পণ্য দিয়াই যদি ব্যবসা করবো, তাইলে রাস্তাঘাটে যে শো-রুমগুলা আছে, ওগুলা কি দোষ করছে? কই ওরা তো এই ব্যবসা শুরু করে নাই।
ঠিক। মাসুদ মাথা ঝাকিয়ে সায় দেয়।
আর বিজিএন যদি পণ্যের ব্যবসাই করবো তাইলে তোগো পণ্য কই? খালি ওই টিভি আর ব্লেন্ডার? এ দুইটা দিয়াই মানুষের সকল পণ্যের চাহিদা মিটবো?
হা হা হা। মাসুদ শংকর দুজনেই ঠা ঠা করে হেসে ওঠে।
বোল্ড হয়ে যাওয়া ব্যাট্সম্যানের মতোই এবার অসহায় বোধ করে সাদমান। তবু আমতা আমতা করে জবাব দেয়, আরে বাবা, আস্তে আস্তে পণ্য বাড়বো।

প্রকাশদা’র কথামতো সাদমান আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, পাড়াত ভাই, অল্প পরিচিত। এরকম প্রায় তিরিশ জনের নাম নিয়ে একটা লিস্ট করেছে। কিন্তু ভুলটা করেছে শুরুতেই, শংকর, মাসুদসহ আরো কয়েক বন্ধুকে সে নিজেই নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রকাশদা অবশ্য আগেই পই পই করে বলে দিয়েছিলো, আপনি যেহেতু এখন নতুন কাউকে বোঝাতে যাবেন না, এখন আপনার কাজ হলো যাদের নাম লিস্ট করছেন তাদের একে একে সেমিনার দেখতে নিয়ে আসা। তারপর আমার কাছে ছেড়ে দিবেন, ব্যস কাজ খতম। শোনেন, মানুষকে বলার মধ্যেও টেকনিক আছে, বুঝলেন? আপনি বলবেন, একটা পার্ট-টাইম কাজ আছে, সপ্তাহে ইচ্ছামতো চার-পাঁচ ঘন্টা কাজ করলেই মাসে চার-পাঁচ হাজার কামানো যায়। শুনে লোকটি নিশ্চয়ই খুব আগ্রহী হবে? তখন বলবেন, কাজটা বুঝতে হলে একদিন অফিসে যেতে হবে। ব্যস, হয়ে গেলো।
পার্ট-টাইমের কথা বলাতেই কাজ হলো। প্রথমবার এলাকার দুইজনকে সেমিনার দেখাতে নিয়ে গেলো সাদমান। সেমিনারের পর যথারীতি প্রকাশদার অসাধারণ ফিনিশিং। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। রাসেল ভাই চালাক মাল। ওনাকে দিয়ে তেমন আশা করে নি সাদমান, কিন্তু বাবুটাতো বোকা টাইপের, ওকে ভালোমতো বোঝালে কাজ হবে ভেবেছিলো।
আচ্ছা, আমি ঢুকে যদি দুইজনরে না ঢুকাইতে পারি তাইলে তোমরাই তো আমার লোক ঠিক কইরা দিবা, না? বাবু জানতে চায়।
হ্যাঁ, তুমি না পারলে তো আমাদের সুবিধার জন্যই তোমার নিচে লোক দিতে হবে। সাদমান দ্রুত বলে।
বাহ, সিস্টেমটাতো খুবই ভালো। আমার পছন্দ হইছে।
বাবুর কথা শুনে সাদমানের চোখ চকচক করে ওঠে।
কিন্তু… সমস্যা হইলো, এতো টাকা পাবো কোথায়? এক কাজ করো না, আমারে সাড়ে সাতহাজার টাকা ধার দাও। এখান থেকে টাকা পাইলে তারপর দিয়া দিবো।
শুনে সাদমান দমে গেলো। এ ধরনের সরল রসিকাতা যে বাবু বোকাটাই প্রথম করলো তা নয়, এর আগেও একজন করেছে।
আরো পরেও কয়েকজন তাই করলো। কয়েকজন আবার বললো, দুইজন আগে ঠিক কইরা নেই তারপর ঢুকবো।
সাদমান হতাশ হয়ে পড়লো। দেখতে দেখতে তেরো জনকে সেমিনার দেখিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু কারো মধ্যে কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আর এদের মধ্যে যে দুজন ঢুকতে ইচ্ছুক ওদের টাকা নেই। তখন সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিলো সাদমান। কাজে নেমে পিছু হটা তার স্বভাব না, একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে সে। মাকে বহুত বলে-কয়ে, শীঘ্র টাকা পাবার সম্ভবনা দেখিয়ে খালার কাছ থেকে আরো সাড়ে সাতহাজার টাকা ধার করে ফেললো। বন্ধু মেহেদিকে সেই টাকা দিয়ে ঢোকালো। মেহেদির সাথে অনেক মানুষের পরিচয়, কতৃত্বপরায়ণ এবং কিছুটা ফাজিল টাইপের ছেলে হলেও ও ভালো কাজ করতে পারবে বলে সাদমানের বিশ্বাস।
কিন্তু এ তো শুধু রাইট হ্যান্ড ফিলাপ হলো, এখন লেফট্ হ্যান্ড ফিলাপ না হলে তো টাকা পাওয়া যাবে না। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, সাদমানের বুদ্ধিও এখানে ঢোকার পরে খুলেছে। ভেবেছিলো নিজে না পারলে ওপরের কেউ হেল্প করে লোক দিয়ে দেবে। আর এখন দেখা যাচ্ছে কথাটা শুধু মুখে মুখে কাজে না। তাছাড়া যে পণ্য বেঁচার নাম করে কোম্পানি ব্যবসা করছে, দুইমাস হয়ে গেলো এখনো সে পণ্যই সাপ্লাই দিচ্ছে না। চীন থেকে আমদানি আসছে না। পণ্য বলতে ব্লেন্ডার অথবা লক্কর-ঝক্কর চৌদ্দ ইঞ্চি চায়না টিভি। টিভিটার দাম বড়োজোড় দেড়হাজার টাকা হতে পারে, ব্লেন্ডারটার দাম তো ছয়-সাতশোর বেশি হবে না। কিন্তু নিয়েছে সাড়ে সাত হাজার টাকা। শংকর ঠিকই বলেছিলো, এ হচ্ছে শুধু টাকার ব্যবসা, এখানে প্রোডাক্ট নামে মাত্র।
সাদমানের পকেটে সব সময় সেই নামের লিস্টটি মজুদ থাকে। আবার লিস্টের বাইরে রাস্তাঘাটে অপ্রত্যাশিতভাবে কারো সাথে দেখা হয়ে গেলে একটু কথাটথা বলার পরই সাদমান পার্ট-টাইম জবের অফার করে বসে। তবে ইদানীং এক্ষেত্রে সমস্যাও হচ্ছে, অফার করতে গিয়ে দেখা যায় কেউ কেউ ইতোমধ্যে এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। এদের মাধ্যমেই সাদমান জানতে পারে নেটওয়ার্কিং ব্যবসায় ঢাকা শহরে আরো তিনটা কোম্পানির অস্তিত্ব। চাইনিজ দুটো, মালয়েশিয়ান একটা।
ইদানীং পরিচিত কেউ কেউ সাদমানকে দেখে রাস্তার দূর থেকে কেটে পড়ে। দেখা হলে সাদমান তো খোঁজখবর নেবেই, কি ব্যাপার, সেই যে সেমিনার দেখে গেলেন, আর তো খোঁজখবর নাই। এই ভয়েই বোধ হয় ওরা এড়িয়ে যায়। সাদমানও যেন পুরোদমে কথার ব্যবসায়ী হয়ে গেছে, সারাক্ষণই মাথার মধ্যে ‘কাকে ঢুকানো যায় কাকে ঢুকানো যায়’ পোকাটা ঘুরপাক খায়। যেন এক স্বার্থবাদী মানুষ সে, স্বার্থ-চিন্তায় সব সময় অন্ধ। কিন্তু এছাড়া আর কি করা, সহজে টাকা আয়ের আর তো কোনো পথ নেই। সাথিকে যে তার পেতেই হবে।
একদিন অফিসে সাদমান দুই মাঝবয়েসি লোকের কথোপকথন শুনে হতাশার মাঝে মনে খুব জোশ পেলো। এক লোক অন্যজনকে বলছে, আমি তো আমার ছেলে এমনকি মেয়েটারেও লাগায়া দিছি। ছেলের অবশ্য মাত্র একটা হ্যান্ড পূরণ হইছে, মেয়েটার নিচে তিনটা লেভেল পূরণ হইয়া গেছে।
বলেন কি!
হ্যাঁ। শোনেন, এই নেটওয়ার্কিং ব্যবসায় মেয়েদের চেয়ে ভালো কেউ করতে পারে না। আপনার তো মেয়ে নাই তো কী হইছে, আপনি ভাবিরে ঢুকায়া দেন।
দেখি ভেবে।
ভালো একটা বুদ্ধি খেলে গেলো সাদমানের মাথায়। ছোটো ফুফুকে ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়? বিজিএন-এ দশটি সাইকেল পূর্ণ হলে কোম্পানি থেকে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের সুযোগ আছে। ফুফুর হাজবেন্ড থাকে সিঙ্গাপুর। ভালোমতো কাজ করলে সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসতে পারবে। ফুফুকে এরকম বুঝালে তো ঢোকার জন্য এক পায়ে খাড়া থাকবে। আর শুধু ফুফুকেই বা কেন, মা, সাথি। এদেরও তো ঢুকিয়ে দেয়া যায়। এরা কোনোরকম কাজ করলেই তো কেল্লাফতে, তখন আর পায় কে!
ফুফু জানালো, সে ঢুকবে, তবে চুক্তি হচ্ছে সাদমান একজন লোক ঠিক করে দেবে, আরেকজন সে নিজেই ঠিক করবে।
সাথি আর মায়ের ক্ষেত্রে সাদমান ঠিক করলো, তাদেরকে এখন না ঢুকিয়ে আগে তারা দুজন করে মেম্বোর ঠিক করুক তারপর না হয় ঢোকাবে। সাথিকে সাদমান নিজেই বোঝালো, আর মাকে নিয়ে গেলো সেমিনার ও প্রকাশদার ফিনিশিং শোনোতে। যাতে এতো বড়ো অফিস আর লোকজন দেখে মায়ের উচ্চ ধারনা জন্মে।
একদিন মাকে বিজিএন অফিসে নিয়ে সেমিনার রুমে বসিয়ে এসে সাদমান প্রকাশদাকে কণ্ঠ নামিয়ে বললো, মাকে নিয়ে এসেছি তো, একটু ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েন, আমি বললে তো বিশ্বাস করে না। আশেপাশে কয়েকজন প্রতিবেশী আছে, ভালোমতো বুঝাতে পারলে তাদেরকে ঢুকাতে পারবে।
শুনে প্রকাশদা ঠোঁট প্রশস্ত করে একটা শুকনো হাসি দিলো, সেই হাসির অর্থ সাদমানের মনে হলো প্রকাশদা যেন তাকে বলছে, আমি খুব খুশি হয়েছি, আপনি এতোটা নীচে নামতে পেরেছেন যে মাকেও এখন কাজে লাগাতে শুরু করেছেন।

পাঁচ.
সাদমানের প্রথম লেভেল পূর্ণ হওয়াতে দেড় হাজার টাকার চেক পেয়ে গেলো। যাক, এই দেড়মাসে এতো পরিশ্রমের পর এ টাকা সামান্য হলেও খুশি সাদমান। কিন্তু কাজ তো আর এগুচ্ছে না। মেহেদিকে যে আশা করে ঢুকিয়েছিলো তাতে গুড়েবালি। ও এখনো কাউকে ঢুকাতে পারেনি। খুব একটা চেষ্টা করছে বলেও মনে হচ্ছে না। নিজের টাকা দিয়ে ঢোকেনি তো তাই গরজ দেখাচ্ছে না। একদিন সকাল সকাল মেহেদির বাসায় গিয়ে ব্যাটাকে ধরে ইচ্ছেমতো ঝারলো সাদমান।
আরে বাবা, আমি তো চেষ্টা করতেছি, কেউ না ঢুকতে চাইলে কী করুম। মেহেদি দুর্বল কণ্ঠে জবাব ছাড়ে।
গলা তুলে ফেলে সাদমান, শালা, সারাদিন প্রেম কইরা বেড়াইলে কাজ করবা কোন সময়?

সাদমানের চোখে অনেক টাকার স্বপ্ন। তিনটা লেভেল কোনোমতো পার করে দিতে পারলেই হলো তারপর আর কোনো চিন্তা নেই। এরপর সে বসে বসে খাবে। কিন্তু তিনটা লেভেলই তো আগাচ্ছে না। এদিকে এসব করতে গিয়ে পড়াশুনারও বারটা বাজছে। কলেজ যাওয়া তো একপ্রকার বন্ধ। তাতে সাদমানের কিছু যায় আসে না, পড়াশুনা যতো যাই বলো সবকিছুর মূল লক্ষ্যই তো টাকা, আর সেতো টাকার দিকেই ছুটছে।
সাদমান তাই থেমে নেই। সপ্তাহে তিন-চারদিন লোকজন ধরে ধরে সেমিনার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে, প্রকাশদা ফিনিশিং দিচ্ছে, কোনোসময় সে নিজেও দেয় যেহেতু এতোদিনে এ গুণ কিছুটা আয়ত্ব করেছে। কিন্তু শেষমেষ ফল সে একই। হয় বলে, একটু ভেবে দেখি, নয়তো বলে, আচ্ছা দুজন ঠিক করে তারপর যোগাযোগ করবো, অথবা বলে, টাকা কই পাই।

ছয়.
একমাস পর।
দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় প্রথমে ভিতরের পাতায় একটি নিউজ আসলো। কদিন পরে আরেকটি পত্রিকায় লালকালিতে একেবারে প্রথম হেডলাইন। তারপরে ক্রমান্বয়ে এই খবর হটকেকের মতো সব পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে আসতে লাগলো। ব্যাপারটা এমন একটা অবস্থায় দাঁড়ালো যেন এতোদিনে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে। খবরটা হলো নেটওয়ার্কিং বিজনেসের প্রতারণা নিয়ে। ঢাকা শহরে পাঁচটি নেটওয়ার্কিং বিজনেস চলছে, এদের মধ্যে তিনটির দেশের অন্য বিভাগে শাখাও আছে। এরা পণ্য বিক্রির নামে লোকজনের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যেকোনো সময় সুযোগ বুঝে লোকজনের টাকা মেরে দিয়ে চম্পট দেবে। অথচ প্রশাসনের চোখের সামনে এরা নির্বিঘেœ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ফলাফল : টনক নড়ে উঠলো সরকারের। কেবল সরকারের নয়, যারা নেটওয়ার্কিং বিজনেসে যুক্ত তাদেরও। ঘন ঘন পুলিশ হানা দিতে লাগলো সেসব অফিসের বড় কর্তাদের ধরতে। কিন্তু এসব বড় কর্তারা তো বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে। হবার মধ্যে যা হলো অফিসগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হবার উপক্রম হলো।
সাদমানদের বাসায় পেপার রাখে না, ঘটনা যে এতো দূর গড়াতে পারে এটা সে ভাবেনি। ব্যাপার কতোটা গুরুতর এটা সে বুঝলো এলাকার এক বেকারির কর্মচারীকে সেমিনার দেখতে অফিসে নিয়ে যাওয়ার পর। সমস্ত অফিস ফাঁকা। দাড়োয়ান ও এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন লোক ভিতরে ঘোরাঘুরি করছে। দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করতে জানালো, অফিস কয়েকদিন বন্ধ, খুলবে শিগগিরই তবে কবে খুলবে এখন বলা যাচ্ছে না।
পরে প্রকাশদা ও অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানালো, সরকারের সাথে কোম্পানির আইনগত জটিলতা চলছে। সরকার বলছে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বানাতে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বড়ো কথা হচ্ছে যতো কিছুই হোক কোম্পানি উঠে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কিছুদিনের মধ্যে সরকারের সাথে একটা আপোস হলেই আবার শুরু হবে।


সাত.
ধার! ধার! ধার!
লজ্জা! লজ্জা! লজ্জা!
সাদমানের একদিকে ধার আরেকদিকে লোকলজ্জা। মাকড়সার জালের মতো ক্রমে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলছে।
নেটওয়ার্কিং বিজনেসের এই শোচনীয় হাল হওয়াতে লজ্জায় দুই সপ্তা সাদমান প্রায় ঘর থেকে বেরুলো না। কারণ তাকে দেখলেই এখন সবাই ‘হায় হায় কম্পানির’ কথা তুলবে, মুখে না হলেও মনে মনে তাকে বলবে ‘চিটার’। আসলে ভুলটা, ভালমতো খোঁজখবর না নিয়ে বিজিএন-এ ঢোকা উচিত হয় নাই। মিরাজকে দোষ দিয়ে কী হবে, দোষ তো তার স্বভাবের, যখন যেটা খেয়াল চাপে সেটা নিয়ে মেতে ওঠে। শংকরের সাবধানবাণী শুনলে আজ তার এই দশা হতো না।
নিজের ভেতরে ক্রমাগত ভাঙচুর চালিয়ে একদিন সাদমান মনস্থির করলো। সিদ্ধান্ত নিলো, আর না, এই ঘোড়ার ডিমের ব্যবসা আর এক মুহূর্ত না। আর যাবে না সেখানে। আবার চালু হলেও না। ওই চাপাবাজির দরকার নাই তার। মানুষকে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে এ-তো এক ধরনের প্রতারণা। দরকার নাই তার এ টাকার। টাকার লোভ এ কদিন তার মাথাটাকে বিগড়ে দিয়েছে, চিন্তার ভেতর স্বার্থপরতা এনে দিয়েছে, যার সাথে দেখা হয়েছে, তাকেই কিভাবে বিজনেসে ঢোকানো যায় তার ঘোঁট পাকাতে হয়েছে। তার ভালোবাসা সাথিকে এমনকি দুনিয়ার সবচে আপন মাকেও সে ব্যাবসার পণ্য হিসেবে কাজ লাগিয়েছে। ধিক! ধিক তার কুৎসিত লোভি মনকে!
পত্রিকায় খবরটা এসে একদিকে ভালোই হয়েছে, দেরিতে হলেও তার উপলব্ধি জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু এখন এ বিধ্বস্ত প্রাঙ্গন সে সামলাবে কী করে? খালার কাছে ধার পনেরো হাজার। ফুফুর টাকাটাও মার গেলো। যাক, তাতে দুঃখ নেই, এক বছর টিউশনির টাকা থেকে আস্তে আস্তে সব শোধ দেওয়া যাবে। আর বিরামহীন পরিশ্রম, সময়, টাকা? তিনটা মাস লোকজনকে বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে অফিসে নিয়ে গেছে, এসব করতে গিয়ে একটা ভালো টিউশনিও হারিয়েছে, কতো কিছু মিস করেছে। সব বৃথা হয়ে গেলো! তা যাক, তবুও তো সে নিজের কাছে স্বচ্ছ হতে পেরেছে। মনে কোনো স্বার্থবাদিতা নাই, বন্ধুরা তাকে দেখে চাপাবাজ বলার তো সুযোগ পাবে না।
অনেকদিন পর সাদমানের মনটা ভীষণ নির্মল আনন্দে ভরে উঠলো। জানলার পাশে ঝুলে থাকা বিকেলের রোদটাকে আজ খুব আপন মনে হতে লাগলো। খোলা আকাশের নিচে এই মুহূর্তে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, সব কিছু ছেড়েছুড়ে আজ সে মুক্ত। বন্ধুদের সাথে কতোদিন ভালো করে আড্ডা হয় না, আজ রাত পর্যন্ত ওদের সাথে আড্ডা মারবে। আর তার আগে সাথির সাথে একবার দেখা করে আসা যাক।

আট.
সাথির বাসায় বিকেলটা কাটিয়ে সন্ধ্যার আযান পড়তেই খুশিমনে সাদমান রাস্তায় নামলো। তার হাতে তখন সাথির দেয়া গল্পের বই, তার পিছনের কাগজে আঠা লাগানো, আর তার ভিতরে সাথির চিঠি। চিঠিটা পড়ার জন্য আকুঁপাকুঁ করছে মন। সাদমান একটা খালি রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লো। সাবধানে চিঠিটা বের করে মেলে ধরলো চোখের সামনে।
‘সাদমান, আমি বাস্তববাদী। তাই সিদ্ধান্তটা অনেক দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত নিয়ে নিলাম। আমেরিকা থেকে আমাদের এক আত্মীয়ের ছেলে দেশে এসেছে বিয়ে করতে। বাবা-মা তার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। ভাবছি রাজি হয়ে যাবো। তুমি আমি সমবয়সী। তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার পরিবার এতোদিন কিছুতেই অপেক্ষা করবে না। এতে সমস্যাই শুধু বাড়বে। আমাকে ভুল বুঝো না। -সাথি’
চিঠিটা কয়েকবার পড়ার পর সাদমান খুব ধীরে ধীরে সেটা ভাজ করে পকেটে রাখে। রিকশায় নিশ্চল বসে থেকে নীরবে আকাশের দিকে চোখ দুটো মেলে ধরে। সে চোখে বোধের নানা রঙ হয়তো খেলা করে তবে শেষতক থাকে কেবল শূন্যতা।

সেপ্টেম্বর ২০০৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *