গল্প, বাংলা

গল্পটি টিউশনি বিষয়ক

“স্ট্যান্ডার্ড থ্রি, ফাইভ ও বাংলা মিডিয়াম দশম শ্রেণী পর্যন্ত সাতটি টিউশনির জন্য যোগাযোগ করুন।
জয়। বিবিএ, ঢাবি। ০১৮৯২৮২১৪৮
(সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড আবশ্যক এবং শুধু আজ ৯টা-৭টা পর্যন্ত)”

শুক্রবারের দৈনিকে আবশ্যক-এ বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়লো ছেলেটির।
রোজকার মতন ‘পেপার’ বলে চেচিয়ে কোলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে হকার পেপারটা ফেলে গিয়েছিল। আওয়াজটা কানে ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে তড়াক উঠে দরজার বাইরে উঁকি মেরেছিলো সে : না, উপর থেকে কেউ নিতে আসেনি, এখনো নিচেই পড়ে আছে। বাড়িওয়ালার পেপার, হকার ফেলে যাওয়ার পর প্রায় বিশমিনিট সেটা নিচেই পড়ে থাকে। সুতরাং এই ফাঁকে পেপারটায় চোখ বুলিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে দেয়া যায়, তবে সব সময় সে সুযোগ মেলে না। আবার আটটা থেকে সাড়ে আটটা হলো হকারের আসার সময়, ঘুম থেকে তাড়াতড়ি উঠে ‘পেপার’ ডাকটার জন্য এলার্ট থাকতে হয়, মিস করলেই সেদিন আর পত্রিকা পড়া হয় না। এ-কারণে একদিন পেপার ফেলে যাওয়ার সময় ছেলেটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে হকার ব্যাটাকে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ভাই, ‘পেপার’ বইলা কষ্ট কইরা চিল্লানের দরকার কি, এম্নে ফালাইয়া গেলেই তো হয়। জবাবে দাড়িওয়ালা কিস্তিটুপি মাথার হকার কিছু বলেনি, শুধু সন্দেহের দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকিয়েছিল। ছেলেটি নিঃশব্দে দ্রুত পেপার এনে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসতে তার ছোটভাইটিও হুমড়ি খেয়ে পড়ে। …ঢাকার দুই ওয়ার্ড কমিশনার খুন, সাবধান : খাদ্যে বিষাক্ত রং, কাশ্মীর সীমান্তে প্রচন্ড গুলিবিনিময়, আরো নয় জনের লাশ উদ্ধার, ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণ… ইত্যাদি প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনামগুলোতে চোখ বুলিয়ে ভেতরের পৃষ্ঠা উল্টায় ছেলেটি। চার নম্বর পৃষ্ঠায় টিউশনির খবর থাকে। আবশ্যক হেডিং এর শেষ বিজ্ঞাপণটা আকর্ষণ করলো তাকে।

হ্যালো… আজকে অ্যাড দিয়েছেন…। ভেঙে ভেঙে শব্দগুলো উচ্চারণ করে রাশেদ।
আপনি কোথায় থাকেন?
আমি কোথায় থাকি সেটা সমস্যা না, টিউশনি যেখানে হোক যাইতে পারবো।
ফোনের দোকানে রিভলভিং চেয়ারে বসে থাকা বিজুভাইকে আড়চোখে দেখলো রাশেদ। কথা শুনছে কিনা। প্রায়ই তো এমন টিউশনির জন্য ফোন করতে আসে। বিজুভাইর সাথে তার সম্পর্ক ভালো তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে বলে বিজুভাই তাকে সমাদর করে কথা বলে। পারিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না, বর্তমানে টিউশনি নেই বলে খুব দুরাবস্থার মধ্যে আছে এবং বেশিরভাগ ফোনই করে টিউশনি নিয়ে, এসব তার কাছে প্রকাশ করতে চায় না।
…আচছা, শ্যাওড়াপাড়ায় সিক্স আছে আড়াই হাজার, বনানীতে এইট আর ফাইভ সাড়ে চার, ধানমন্ডিতে …
আপনাদের কন্ডিশন কি ?
আড়াইশো টাকা মেম্বার ফি আর টিউশনির ফার্স্ট মান্থের ফিফটি পার্সেন্ট…।
টাকার মাধ্যমে টিউশনি দেয়া হয় এই ব্যাপারটাই রাশেদ জেনেছে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়। এক বন্ধুর কাছে টিউশনি চাইতে বলেছিল। মাখন লালের কাছে যা, টিউশনি পাইলে পরে প্রথম মাসের ফিফটি পার্সেন্ট দিয়া দিবি।
মানে? রাশেদ অবাক হয়, টাকা দিয়া টিউশনি পাওয়া যায়?
যাইবো না ক্যান? কোন দুনিয়ায় আছছ তুই? টাকা দিয়া স-ব পাওয়া যায়। অই মাখন ব্যাটার ব্যবসাই তো এইটা, নিজে টিউশনি করায় আর মাইনষেরে টিউশনি দ্যায়।
মাখন লালকে পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো রাত নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে বাজারে তার বন্ধুর সাধন ফার্মেসীর দোকানে খোঁজ করা। রাশেদ প্রায় মাসখানিক মাখনের পিছে দৌড়াদৌড়ি করে, সাথে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে একটা ভালো টিউশনি পেয়েছিল। তবে চল্লিশের কাছাকাছি ভারি শরীরের ভুঁড়িওয়ালা মাখন লাল খুব সেয়ানা হলেও ধোঁকাবাজ ছিল না।

৯ নম্বর বাসে মিরপুর-১ নম্বর কিয়াংসি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের কাছে নেমে মুখের ঘাম রুমালে মুছতে মুছতে রাশেদ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো চারটা বাজে। একটু হাঁটতে ফোনে বলা জয়ের ঠিকানানুযায়ী জননী কমপ্লেক্স মিলে গেলো। নিচতলার সরু প্যাসেজে ঢুকে ডানদিকের দুইটি দোকানের পর থাই গ্লাস লাগানো দোকানটি পেয়ে গেলো। কাচের দরজা বাঁদিকে ঠেলে রাশেদ ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো : তিন-চারজন চেয়ারের অভাবে দাঁড়িয়ে আছে, ডেস্কের বাঁ-দিকে একটা চেয়ারে বসে ফোনে কথা বলছে ফর্সা এক যুবক, বাঁ-হাতে মোটা সিলভার চেইনের ঘড়ি আর মুঠোতে সিমেন্সের মোবাইল সেট। যুবকটির মুখোমুখি দুটি চেয়ারে দুইজন বসা। দোকানটির দেয়ালের তিনদিকের রেকে থরে থরে সিডি-ডিভিডি সাজানো, একদিকে ফটোস্ট্যাটের কাজ চলছে, তার পাশে একটি কম্পিউটার। ফোনে কথা শেষ হলে যুবকটি রিসিভার রেখেই তার সহজাত কত্রিত্ববোধ নিয়ে বলে উঠলো, ভাই পাঁচ মিনিট পরে আসেন।
সম্ভবত ওর নামই জয়। রাশেদ বের হয়। বুঝতে পারছে না যুবকটির কথায় তার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগা উচিত কিনা। ঘি রঙের শার্ট গায়ে কালো সু পরা একজনও তার সাথে বেরিয়ে আসে। দেখেই বোঝা যায় রাশেদের মতো একই ধান্ধায় এসেছে। রাস্তার ধারে দাঁড়ায় সে। ভালই হয়েছে অ্যাতো লোকের সামনে টিউশনি নিয়ে আলাপ করতে কেমন অস্বস্তি লাগতো তার। ঘি রঙা শার্টের যুবকটি তার কাছেই দাঁড়িয়েছে, কয়েকবার মুখ ঘুরিয়ে দেখলো তাকে।
আপনি কি… টিউশনি?
হ্যাঁ। ঘি রঙা শার্ট পরা যুবকটির সলজ্জ উত্তর।
এরা ঠিকঠাক মতো টিউশনি দিবে তো, নাকি ভাঁওতাবাজি করবে? রাশেদ সহজ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে, কি মনে হয় আপনার?
আমি তো সকালে মেম্বার হয়েছি, এখন টিউশনিতে যাবার কথা। ঘি রঙা শার্টের যুবক বলে চলে, ভাঁওতাবাজির দরকার হয়না, সকাল বেলায় দেখলাম এরা কিভাবে টিউশনি আনে..। এই ধরেন, পত্রিকায় পড়াব-তে এ্যাড দেয় বুয়েটে পড়ছি, ইউনিভারসিটিতে পড়ছি, ডাবল স্ট্যান্ড, এক্স ক্যাডেট, ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত ইত্যাদি গাঁজাখুড়ি গল্প। তারপর আপনাকে দিয়েই বুয়েট সাজিয়ে ফোন করাবে, বলেন তবে টিউশনি থাকবেনা কেন?
দ্বিতীয়বার রাশেদ টিউশনির অভাবে পড়েছিল ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর। তার আব্বার মুদি দোকানে তেমন বেচাকেনা নাই, সংসারই চলতে চায় না, এর উপর মা অসুস্থ। রাশেদের নিজের খরচটা তো অত্যন্ত নিজেকে চালাতে হবে। আবার সেই মাখন লালের খোঁজে গিয়ে জানতে পারলো : মাখন এদিকে আসেই না, একটা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করে বড়ো দাও মেরেছে। এখন ধানমণ্ডিতে থাকে আর ব্যবসা করে। তখন উপায়ান্তর না পেয়ে পত্রিকায় টিউশনির বিজ্ঞাপন দেখে একদিন নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে চলে এলো। সেখানকার মিডিয়া সেন্টারগুলাতে ঢুকলেই প্রথমে একটি ছক-কাটা কম্পিউটারাইজড কাগজ ধরিয়ে দ্যায় যাতে টিউশনি কোন ক্লাসের, বাসা কোথায়, কিসে পড়ছে, কতো দিবে আর সপ্তাহে কয়দিন যেতে হবে তার ফিরিস্তি দেয়া থাকে। বেশ কয়েকটাতে সেদিন ঘুরে ধন্ধে পড়ে গেল, সত্যি সত্যি টিউশনি পাবে তো? একটু রিস্ক তো নিতেই হবে, তাছাড়া দোকান যেহেতু চিটিং করে যাবে কোথায়? পরদিন টাকা নিয়ে এসে ২০০ টাকা মেম্বার ফি আর ফিফটি পার্সেন্ট একহাজার টাকা দিয়ে পাঞ্জেরী টিউশনি মিডিয়া থেকে শুক্রাবাদে ক্লাস নাইনের একাউন্টিং-এর টিউশনি নিলো। অবশ্য নিজেকে তখন তার জগন্নাথের একাউন্টিং-এর ছাত্র বলে মিথ্যে পরিচয় দিতে হয়েছিলো। বিকালে সেই ঠিকানা নিয়ে শুক্রাবাদ এরিয়ায় দুইঘণ্টা খোঁজার পরও বাসা পাওয়া যায়নি। শেষপর্যন্ত অবশ্য সেই মিডিয়া সেন্টারে আসা-যাওয়া করতে করতে জুতার তলি ক্ষয় হওয়ার মাঝপথে একদিন রাশেদ মূলধন উঠাতে পেরেছিলো : এক বিকেলে সেই মিডিয়া সেন্টার গিয়ে দেখে তার মতো আরও কয়েকজন বসে আছে অথচ মালিকের দেখা নেই। সবাই টাকা-পয়সা দিয়েছে কিন্তু কারও টিউশনি মেলেনি। এখন শুধু আজ আসেন কাল আসেন বলে ঘুরাচ্ছে। একেকজনের একেকরকম অভিজ্ঞতা :
আরে মহাখালি ডি.ও.এইচ.এস-এ আমারে এমন ঠিকানা দিছে যে ঐ ঠিকানার কোনো অস্তিত্বই নাই। মুখে চাপ দাড়িওয়ালা যুবকটি ক্ষোভের সাথে বলে।
ফোন নাম্বার চান নাই? লম্বা-চওড়া একজন বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করে। চাইছি না আবার? বলছে গার্ডিয়ান খালি বাসার ঠিকানা দিছে।
আমার টিউশনির অবশ্য বাসা পাইছিলাম। আরেকজন বলতে থাকে, গার্ডিয়ানের সাথে আলাপের পর বলছে, ফোন কইরা জানাইবো। কিন্তু একমাস হইয়া গেলো কোনো খবর নাই।
এইসব সব অগো সাজানো, ওদেরই কোনো লোকের বাসায় পাঠাইছে। চেয়ারে বসা একজন চেচিয়ে ওঠে।
ঠিকই বলছেন, এরকম হয়, আমিও শুনছি। তার পাশেরজন সায় দেয়।
আবার গার্ডিয়ানরাও চালাক আছে ভাইরে, ভদ্রগোছের একজন প্রতিবাদ করে, আমারে মগবাজারের এক টিউশনিতে পাঠাইছিলো। তো যাওয়া মাত্রই ছাত্রের মোটাসোটা মা কম্পিউটার কম্পোজ করা একটা কন্ডিশনশিট বাড়াইয়া দেয়। তাতে পয়েন্ট দিয়ে লেখা :
১. কাটায় কাটায় দু’ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচদিন পড়াতে হবে
২. ঠিক সময়ে আসতে হবে
৩. ছাত্রকে মুখে মারা যাবেনা
৪. স্কুলের হোমওয়ার্ক পড়িয়ে যেতে হবে
৫. অগ্রিম টাকা নেয়া যাবেনা
৬. গ্রামে বা বাইরে কোথাও গেলে আগে ছুটির দরখাস্ত…।
এমনি আরো সব শর্তে পৃষ্ঠা ভর্তি। তাও ভাই, এই টিউশনি-চাকরিতে রাজিই ছিলাম কিন্তু জাম্বুরা মুখের মহিলাটি শেষে বললো, পাঁচ-ছয়দিন দেখবো, ভাল পড়ালে তারপর জয়েন। এই কথা শুইনা না কইরা দিলাম। কথা শেষ করে বক্তা দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলে।
আমি তো বছরখানিক আগে এক মজার টিউশনি করাতাম। কাঁধে চটের ব্যাগ ঝোলানো এক তরুণীর মুখে এবার কথা ফোটে।
সবাই মেয়েটির কথায় মনোযোগ দ্যায়। বোঝাই যাচ্ছে মিডিয়াতে টিউশনি নিতে এসে সবার তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোই এখন গল্পের বিষয়বস্তু। যেন কষ্টের কথাগুলো বলে বুকটা হাল্কা করছে, পরস্পর সহজ হয়ে উঠেছে।
এ’ লেভেলের এক মেয়েকে বাংলা পড়াতাম, তরুণীটি বলতে থাকে, সপ্তাহে তিনদিন তিনহাজার। তবে প্রতিমাসে ওই স্টুডেন্টরে একহাজার দিতো হতো। পড়া শুরুর প্রথম দিনই মেয়েটা শর্ত দিয়েছিলো, বেতন পেয়ে প্রতিমাসে আমাকে একহাজার দিয়ে দিবেন, রাজী থাকলে বলেন নইলে আপনার টিউশনি ডিসমিস হয়ে যাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমার অন্য টিচারদের থেকেও এরকম পার্সেন্টেজ নেই। আপনার তেমন কষ্ট নেই, সপ্তাহে তিনদিন আসবেন, কোনোরকম একঘণ্টা থেকে নাস্তা খেয়ে চলে যাবেন।
বাহ দারুন টিউশনি তো। চাপ দাড়ির যুবকটি উৎফুল্ল হয়, টিউশনির বাসায় নাস্তা নিয়ে আমার এক মজার ঘটনা আছে। এক বড়লোকের বাসায় পড়াইতাম কিন্তু সন্ধ্যায় নাস্তা দিতো না। একদিন পড়ানোর মাঝে বুদ্ধি কইরা ‘একটু আসতাছি বইলা’ বাইরে গিয়া পনেরমিনিট কাটাইয়া আসলাম। তার পরদিনও গেলে স্টুডেন্ট জিজ্ঞেস করলো, স্যার কোথায় যান? একটু অ্যাঁ উঁ করে বলে ফেললাম, সন্ধ্যাবেলা তো একটু চা-টা খেয়ে আসলাম। এরপর থেকা প্রত্যেকদিন নাস্তা দিতো।
হা-হা-হা। উপস্থিত সবাই বক্তার কথায় মজা পেয়ে হেসে ওঠে।
দেইখেন, বিড়ালে খাওয়া পায়েস ফালাইয়া না দিয়া টিচাররে খাইতে দিছে এমন ঘটনাও আমি শুনছি। লম্বা-চওড়া লোকটি হাসতে হাসতে দাড়িওয়ালার উদ্দেশ্যে বলে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ দেখে দাড়িওয়ালা আবার কথা শুরু করে, এইসব মিডিয়াগুলাই কিন্তু আবার চাকরি, পাত্র-পাত্রির ভুয়া বিজ্ঞাপন দ্যায়। মাঝে মাঝে পত্রিকায় দ্যাখেন না, ‘আমেরিকান সিটিজেন পাত্রির জন্য আমেরিকা যেতে ইচ্ছুক পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন? গেলে বলবে তাড়াতাড়ি বায়োডাটা আর ছবি দেন, কোনো কোয়ালিফিকেশন দরকার নেই। মেয়ের গার্ডিয়ান চায় খালি একটা ভালো সৎ নামাজি ছেলে। তারপর শেষে বলবে, আগে আমাদের মেম্বার ফি মাত্র ৫০০ টাকা দিতে হবে। মানুষ তো মনে করে, আমেরিকার নাগরিক হওয়ার সহজ সুযোগ, ৫০০টাকা গেলে যাক।
হ্যাঁ, এরকম একটা বিজ্ঞাপন দিয়া ২০-২৫ জনের কাছ থেকা ৫০০টাকা কইরা পাইলে তো অনেক। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একজন মন্তব্য করে, আসলে এইসব সবই ভুয়া, গরিবগো ঠকাইয়া আরো গরিব বানায়।
এরকম কথা বলতে বলতে ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে প্রায় পনেরজন জড়ো হয়ে গেলো, এর মধ্যে একজন ছিলো ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র যে তার ফিফটি পার্সেন্ট টাকা আজকে ফেরত না পেলে সে কলেজের সরকারি দলের ছাত্রদের এনে দোকান ভাঙচুর করাবে। সবাই তাকে সমর্থন দিলো, আজকে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। উত্তেজিত জনতা একসময় জোর করে দোকানের টেবিলের কাগজপত্র ঘাটলে প্রমাণ হিসেবে পাওয়া গেলো কম্পিউটার কম্পোজ করে বানিয়ে রাখা এক তাড়া ভুয়া টিউশনির শিট। আর যায় কোথায়! উত্তেজিত জনতা তখনই দোকান ভাঙচুর করার সিন্ধান্ত নিলো। হৈচৈ শুনে তড়িঘড়ি মালিক সমিতির লোক এসে ভয়ে আধমরা দোকানের কর্মচারিটিকে পাঠিয়ে তিরিশ মিনিটের ভিতর ওর মালিককে আনালো। মালিক এসে যারা যারা ছিলো পকেট থেকে টাকার বান্ডিল বের করে সবাইকে মেম্বার ফিসহ ফেরত দিলো। টাকার বান্ডিল দেখে রাশেদের মনে হয়েছিলো, মালিক ব্যাটা বোধ হয় আগে থেকেই টাকার যোগাড় রেখেছিলো যেন ব্যাপারটা ঘটবে সে জানতো। পাঞ্জেরী টিউশনি মিডিয়ার টাকা উঠাতে পারলেও রাশেদ কনফিডেন্স মিডিয়াতে যে শুধু মেম্বার ফি দিয়েছিলো সেটা কিন্তু উঠাতে পারেনি।
চেয়ার দুটো মানুষ তিনজন। রাশেদ আর ঘি রঙা জামার যুবকটি বসতে পেরেছে, অন্যজন দাঁড়িয়ে।
শ্যাওড়াপাড়ায় একটা ছিল…রাশেদ জয়কে মনে করিয়ে দেয়।
ওগুলো হয়ে গেছে, কমার্শিয়াল জবাব জয়ের, এখন আপনি বনানীরটা নিতে পারেন।
ঠিক আছে।…তাহলে কি করতে হবে?
এই ফর্মটা ফিলাপ করেন। একটা বায়োডাটা গোছের কাগজ বাড়িয়ে দিল জয়।
ফর্মটায় রাশেদ একবার চোখ বুলালো। বায়োডাটাই বটে। আট নম্বরে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস। ঠোঁটের কোণটা নড়ে উঠলো তার, টিউশনি করতে এসে ম্যারেড না আনম্যারেড তাতে কি হবে? কিন্তু ফর্মটা পূরণ করা মানে তো আড়াইশো টাকা দিয়ে মেম্বার হওয়া।
..তা ভাইয়া ফিফটি পার্সেন্টের টাকা তো আমি কাল বা পরশু দিতে পারবো। টিউশনি থাকবে তো?
ওপাশের চেয়ারে বসে থাকা জয় জানায়, কালকে নিয়ে আসেন, কালকেই জয়েন করাইয়া দেই।
দু’চোখে এখন রাশেদের স্বপ্ন কড়াইতে তেলে ডুবিয়ে মাছ ভাজার মতই ভাজা হতে থাকে : জয় টিউশনি নিয়ে ঘুরাবে না। বিশ্বাস করা যায় কারণ জয় নিজেও ঢাবির ছাত্র। একটা যদি ঠিকঠাক মত পাওয়া যায় তবে আরেকটা নেবে। দুটা থেকে হাজার পাঁচেক টাকার মত আসলে তিন-চার মাসেই সব ধার শোধ করতে পারবে। টিউশনির প্রথম মাসের টাকাটা পেয়েই একজোড়া জুতা কিনবে। জুতাজোড়ার যা অবস্থা! সেদিন তো তার এক ফ্রেন্ড বলেই ফেললো, তোর মোঘল আমলে কেনা জুতাটা এইবার পাল্টা, আর কত দিন পরবি? কেনা দরকার ভাল একটা টিশার্টও।
এই যে, ভাড়া দ্যান। বাসের কন্ডাক্টর বিরক্তির সাথে রাশেদকে নেড়ে দিল। ভাড়া মিটিয়ে আবার সে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাবনায় তলিয়ে যায়। প্রায় চারমাস তার টিউশনি নেই। ইনকামও নেই। বন্ধুবান্ধব পরিচিতজন সবার কাছ থেকে ধার নিয়ে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিপদে পড়লে মানুষ আশেপাশের জনদের থেকে টাকা পয়সার ব্যাপারে যেরকম সাহায্য পায়, সেই সাহায্যের বলয়টিও রাশেদ অতিক্রম করেছে। প্রায়ই সে শুনতে পায় তার সম্বন্ধে অন্যরা অভিযোগ তুলছে : রাশেদকে কোনদিন দেখলাম না দুইটা টাকা খরচ করে…খালি আছে মানুষেরটা খাওয়ার তালে..। কী করতে পারে সে? মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে রাতের আঁধারে একটা ছুরি নিয়ে..।টেনশনে টেনশনে তার পড়া হয়না।প্রতিদিনই তো পেপারে আবশ্যক-এ টিউশনির এ্যাড দেখে, পছন্দসই হলে ফোন করে, কিন্তু কথাবার্তা বলে আর মন ওঠে না, তাদের একই গান। আপনি অফিসে আসেন, মেম্বার হন..। তাজয়ের এখানে টিউশনি কনফার্ম দেবে কারণ এদের তো আর টিউশনি পেতে সমস্যা হয় নেই। বলতে হবে অমুকখানে পড়ি, এসএসসিতে মার্কস্ ৯২০, এইচএসসিতে.. এক্স ক্যাডেট.. , তা একটু মিথ্যে বললে যদি কাজ হয় অসুবিধা কি রাশেদের?
এখন দরকার ইমনকে। এইতো কয়েকদিন আগে আরেকটি মিডিয়া থেকে টিউশনি হওয়ার কথা হযেছিল, তখন এই আসন্ন জ্বলোচ্ছ্বাস কে ঠেকাবে? চারদিকে টাকাকড়ির আকাল পড়লে ইমনকে জানালে সমস্যা সমাধান। ছেলেটা বড়লোকের আট-দশটা নন্দদুলালের মত হলেও বন্ধুবান্ধবের টাকা পয়সার সমস্যায় বেশ সাহায্য করে। চারবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রিসভার উঠায় ইমনের মা। বললেন ইমন ঘুমাচ্ছে। রাশেদ জানে তিনি মিথ্যা বলছেন, তাই সভয়ে উচ্চারণ করলো, একটু জাগানো যাবে না? অনুরোধটা শুনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে এফ সিক্সটিনের মত গর্জে উঠলেন, না, এবং আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে ফোনটা রেখে দিলেন। গলার ঝাঁঝে বিরক্তভাব মাটিতে শিল পড়ার মতো এমনভাবে আছড়ে পড়ছিল যেন তার বড়লোক ছেলেকে বোকা পেয়ে সবাই লুটেপুটে খাচ্ছে, তিনি দু’হাতে তা প্রতিহত করতে চাইছেন।
রাশেদ একটু দমে গেলেও হঠাৎ করেই ওর আত্মসম্মানবোধটা গোখরোর মত ফনা তুলে দাঁড়ালো। সে কিসে কম? তার মা-র এত গর্ব করার কি আছে ইমনকে নিয়ে? যে ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করতে না পেরে ভূয়া সার্টিফিকেট বানায়, কলেজে ভর্তি হয়েছে বলে বাবার কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা খসায়, ইন্টারমিডিয়েটের ফল বেরুলে বাসায় বাসায় মিষ্টি বিলিয়ে বলে, দু’টা লেটার সহ ফার্স্ট ডিভিশন। ধিক তার মাকে! ধিক তার মার মিথ্যা গর্বকে! তার তুলনায় ইমন কিছুইনা। ইমনের পক্ষে কখনো সম্ভব না ইউনিভার্সিটিতে পড়া। শুধু টাকার জোরেই বেঁচে আছে ইমনরা, নয়তো ওর মত ছেলে কবেই।
ঘাই দিয়ে সময় যত বাড়ছে রাশেদের উদ্বিগ্ন মন ততই ঘোলা হচ্ছে। কাল বিকেলের মধ্যে টাকা নিয়ে যেতে হবে ওকে। আজ যদি ওর মা বেচে থাকতো, টাকা যোগাড়ের চিন্তাটা আর করা লাগতো না! বাবার কাছে টাকা চাইবে নাকি? মনে হয়না পাওয়া যাবে, সপ্তাহখানেক ধরে ডালভাত আলুভর্তা ডিম চলছে, টাকা না থাকাটাই স্বাভাবিক। আর এ অভ্যাসটাও তো নেই। ছোটবেলা হতেই কিছু দরকার হলে মাকে বলতো, মা বলতো বাবাকে। মনে মনে ওর কেমন ভয় ছিল বাবার প্রতি। আজ এত বড় হয়েও সেটা কাটাতে পারেনি, ভয় নেই তবুও কেমন অস্বস্তি। মা’টা মরে গিয়ে যেন বেঁচে গেছে, সে তো কিছু হলেই তাকে বলতো, এখনতো বুঝিসনা, মরলে বুঝবি। হ্যাঁ, এখন অনেক কিছুই বুঝেছে রাশেদ, মা’র অভাব হাড়ে হাড়ে শীতের কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে এখন আকাশ ফাঁটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওর : তুমি ফিরে এসো মা। আমিতো বুঝেছি.., কতদিন মা বলে ডাকিনা, তোমার মতো করে অনেকদিন কেউ বকেনা, বাইরে যাবার সময় তোমার সাবধান বাণী শুনতে পাইনা। অই ঠিকটাক মত যাইছ, আজকে স্বপ্নে খারাপ দেখছি।..মা, মাগো, বাসাটা এখন পাতা ঝরা শীতের শুকনো বৃক্ষের মত নির্জীব, ঘর-দোরে ঝুল পড়ে থাকে, তিন-চারদিন একই জামা পড়ে ময়লা হয়ে যায়। কেউ দেখার নেই। মুনিয়াটাও একা একা থেকে কেমন রোগা হয়ে গেল। মুখটা কত পরিষ্কার ছিল ওর। ঠিক তোমার মত, অথচ দেখ, সারাটা মুখে ওর এখন অসুস্থ মানুষের মলিনতা, ভাতের মাড় গালতে গিয়ে হাতটা পুড়িয়ে ফেলেছে। আঙ্গুলগুলো বুড়ো মানুষের চামড়ার মত খসখস করে। সংসারের সমস্ত কাজ ওকেই করতে হয়। কলেজ যাওয়া প্রায় বন্ধ। আগেতো বুঝিনি মা, তুমি চলে গেলে শুধু আদরটাই না মাথার উপরের খড়সহ সমস্ত কিছুই ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সংসারে তোমার প্রয়োজন যে সর্বত্র। ঘর হতে বাহির।
ইমনের মোবাইলে ফোন করলে কেমন হয়? রাশেদ ভাবলো, কথা বলতে সময় লাগবে, টাকা বেশি লাগবে, তা লাগুক। দিনদশেক আগেইতো ইমন দু’হাজার টাকা ধার দিতে রাজি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ওই মিডিয়াকে ঠিক রিল্যায়েবল মনে হয়নি বলেই সে টাকাটা নেয়নি। লাভ কি খামাখা নিয়ে, রাশেদের কাছে রাখলে খরচ হতে শুরু করবে। আর সে তো বলেই রেখেছে টিউশনি হলে পরে আবার চাইবে।
হ্যালো ইমন?
হ্যাঁ দোস্ত, আমি তো এখন ক্লাবে। স্পোটর্সজোনে। ইমনের ফুরফুরে কণ্ঠ শোনা গেল। … তোর কি খবর? বাসায় দুইবার ফোন করেছিস! কেন? ..ও টাকা? এখন তো দিতে পারবো না। পরশুদিন কক্সবাজার ট্যুরে যাচ্ছি, একেকজন ছয়-সাতহাজার বাজেট, তোকে কোত্থেকে দেবো।
কিন্তু আমি যে তোর উপর ভরসা করে ওদের মেম্বার ফি দিয়ে এলাম। ..আচ্ছা কষ্ট করে একহাজার দে।
তুই বুঝতে পারছিস না, আমার নিজেরই আরো কিছু টাকা দরকার। আমরা সবাই তো ধর ভালো হোটেলে থাকবো, মাল খাবো.. মেয়েছেলে নিয়ে একটু.., তারপর দশদিনে প্রচুর খরচ পড়বে, বুঝিস না?
ও আচ্ছা, গলায় স্বর ফোটে না রাশেদের, কী আর করা, থাক।

জুলাই ২০০২। প্রকাশ : সংবাদ, ৬ জুলাই ২০০৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *